ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

প্রতিবেশী

উত্তেজনা কমাতে ভারতেরই ইতিবাচক ভূমিকা দরকার

উত্তেজনা কমাতে ভারতেরই ইতিবাচক ভূমিকা দরকার

আমেনা মহসিন

আমেনা মহসিন

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৬ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:০৬

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সাম্প্রতিক টানাপোড়েন আমরা দেখেছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। আমরা তাঁর এ সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। আমাদের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠকের পর তাদের দিক থেকে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। এখানে কয়েকটি বিষয় বলা দরকার। 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজে করতে চান। আমি মনে করি, এটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারত একই সঙ্গে আমাদের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নিয়ে উদ্বিগ্ন। অথচ আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের কোনো হস্তক্ষেপ চাই না। কারণ বাংলাদেশও ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। ভারতে কিছু ঘটলে আমরা সব সময় সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখেছি। নিশ্চয় আমাদের মধ্যে ‘সেলফ ক্রিটিসিজম’ ও ‘সেলফ রিফ্লেকশন’ আছে। সে কারণেই এমনকি সরকার ভারতীয় মিডিয়াকেও বাংলাদেশে এসে বাস্তব পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারত তাদের মিডিয়া ডেলিগেশন পাঠাবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি আমরা স্পষ্ট করেছি। 

এ পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের আগমন আমার কাছে ‘আইস ব্রেকিং’ মনে হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে বিমানবন্দরে কে অভ্যর্থনা জানাল, তা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটা আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। কারণ কূটনৈতিক নিয়ম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল অনুসারে তাঁকে রিসিভ করা হয়েছে, এটাই বাস্তবতা।
তবে ভারতীয় মিডিয়া যা করছে, সেটা বাড়াবাড়ি। তাদের কাউন্টার করার দায়িত্ব বাংলাদেশের মিডিয়ার। মিডিয়ার উচিত তথ্য-প্রমাণভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা। আমাদের যে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আছে, তাদের দায়িত্ব আছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা প্রভাবশালী, তারাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারেন। 

আমরা দেখছি, আমাদের মিডিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘রিঅ্যাক্টিভ’ থাকে। তাদের উচিত ‘প্রোঅ্যাক্টিভ’ থাকা। একই সঙ্গে আমাদের এখানে যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কিছু ঘটনা ঘটেছে, সেটাও স্বীকার করে নিতে হবে। তবে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ভুয়া প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, তা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি এবং বাস্তবতাবর্জিত। 
সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, ভারতের অন্তত ৪৯টি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। আমরা জানি, সংবাদমাধ্যম যাচাই-বাছাই করে তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু ভারতের অনেক মূলধারার সংবাদমাধ্যমও বাংলাদেশ বিষয়ে অসত্য বা বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রকাশ করেছে। গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রচারকারী সংবাদমাধ্যমকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও প্রোঅ্যাক্টিভ হয়ে সত্যতা জানানো দরকার কিংবা প্রতিবাদলিপি পাঠানোও গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়ার ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের ইতিবাচক যেসব বিষয় আছে সেগুলো তুলে ধরা। 

অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তাদের সঙ্গে ভারতের একটা বোঝাপড়া ছিল। সেই সরকার না থাকা তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। যদিও আমরা দেখছি, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ইতিবাচক কথাই বলে গেছেন। অফিসিয়ালি বক্তব্য দিতে গেলে পজিটিভিটির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের ভেতরের পরিস্থিতি বোঝা কঠিন। তা ছাড়া ভারতের বিভিন্ন সংগঠনের যে ভূমিকা আমরা দেখছি; যেভাবে সেখানে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন আক্রান্ত হয়েছে এবং এখনও সেখানে মিডিয়াসহ নানামুখী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সরকার পরিবর্তনের কারণেই আসলে এত কিছু হচ্ছে।

এটা মনে রাখতে হবে, ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। আমরা নানা কারণে একে অপরের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক অস্বীকারের সুযোগ নেই। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া একাত্তরে ভারতের ভূমিকা আমরা বড় করেই দেখি এবং স্বীকার করি। সম্পর্ক ভালো থাকলে বাংলাদেশ-ভারত উভয়েই উপকৃত হতে পারে। ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ আমাদের স্বার্থেই দরকার। 

দুই দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত থেকে প্রায় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। চলমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও দেশটির সহযোগিতা প্রয়োজন। তা ছাড়া প্রতিবছর পর্যটন ও চিকিৎসার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করেন। তাদের ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার সেবা সহজীকরণ গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতার বিকল্প নেই।

এটাও সত্য, ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয় অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। আমরা দেখেছি, দুই পররাষ্ট্র সচিবের প্রেস ব্রিফিংয়েও বিষয়গুলো উঠে এসেছে। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্তসংশ্লিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা দরকার। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো বিশেষত তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করা দরকার। গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা নবায়নের বিষয় আছে। তা ছাড়া যে ক’টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি দুই দেশের মধ্যে আলোচনাধীন, সেগুলোসহ অন্যান্য বিষয় সম্পন্ন করার জন্যও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
আশু কর্তব্যের কথা যদি বলি, এখন দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সেটি কীভাবে আমরা কমাতে পারি, সেখানে জোর দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ভারতকেই ইতিবাচক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা নিতে হবে। আর আমাদের দিক থেকে মিডিয়ার কাউন্টারের বিষয়টি এখন অগ্রাধিকার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তিকর বয়ান বিষয়ে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অনুরোধ জানানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। এখানে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমেরও তৎপরতা জরুরি। একই সঙ্গে জোরালোভাবে এই বার্তা দিতে হবে যে, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত।

ড. আমেনা মহসিন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×