উদ্যোগ
প্রবীণের জন্য ‘থ্রিফট স্টোর’
ফাইল ছবি
গোলাম শওকত হোসেন
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৫
থ্রিফট স্টোর পৃথিবীর একেক জায়গায় একেকভাবে নামকরণ করা হয়। ইংল্যান্ডে বলা হয় ‘চ্যারিটি শপ’, অস্ট্রেলিয়াতে ‘অপ শপস’; যুক্তরাষ্ট্রে বলা হয় ‘থ্রিফট স্টোর’। প্রবীণের অবসর সময়কে কাজে লাগানোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত বিত্তবানদের ব্যবহারের যে কোনো জিনিসই ছিল অতি মূল্যবান ও সেগুলো হাতে তৈরি হতো খুব যত্ন সহকারে। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর সেসব জিনিস অনেকটা সস্তা ও সহজলভ্য হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সমাজে কিছু লোক বেকার ও দরিদ্র হয়ে যায়। অন্যদিকে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’তত্ত্বে থ্রিফট স্টোর’ ব্যবসার প্রসার লাভ করে ও বেকাররা এখানে আগ্রহী হয়ে পড়ে।
এই ধারণাকে ভিত্তি করে ১৮৬৭ সালে লন্ডনে তৈরি হয় ‘স্যালভেশন আর্মি’, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি দেখা যায়। এতে বেশির ভাগ কাজ করে যুদ্ধফেরত বা আহত বেকার সৈনিকরা, যারা হতাশায় ভোগে ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। স্যালভেশন আর্মির প্রধান লক্ষ্য, এদের কাজে যুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এর আদলে ইংল্যান্ডে ১৮৯৯ সালে তৈরি হয় ‘উলভারহাম্পটন সোসাইটি ফর ব্লাইন্ড’। এর আলোকে তৈরি হয় ‘গুড উইল’। তবে এ ধরনের সব সংস্থা মূলত পরিচালনা করে প্রবীণরা, যদিও মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য বেশ কিছু তরুণ-তরুণী অর্থের বিনিময়ে বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে।
এসব প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছাসেবী, যারা সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য নিয়ে পরিচালিত হয়; বিত্তশালীরা এসে তাদের পরিত্যক্ত যে কোনো অস্থাবর জিনিসপত্র এখানে দান করেন এবং দান করার সময় তাদের আনুমানিক মূল্যের দানের রসিদ হিসেবে দেওয়া হয়; এগুলো মূলত অভাবী প্রবীণদের দ্বারা পরিচালিত, যার বিনিময়ে তারা ভাতা পায়; জিনিসপত্র বিক্রি করে যা রোজগার হবে, তার আয় তিনটি ভাগে বিভক্ত করে এক অংশ যায় প্রতিষ্ঠানের জন্য, এক অংশ যায় যারা কাজ করে তাদের ভাতায় এবং বাকি অংশ যায় ইমার্জেন্সি ও ডেভেলপমেন্ট খাতে। যারা দান করে তাদের যে দানের রসিদ দেওয়া হয় সেই রসিদটি বছর শেষে যখন সেই দাতা ইনকাম ট্যাক্স ফাইল করে তখন তাদের ট্যাক্সে রিবেট দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সমাজে যে কোনো বয়সের (সাধারণত ১৮ বছরের ওপর) মানুষ এখানে এসে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারে, যেটা তার সরকারি সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরের বিপরীতে পরোপকারী ভালোমানুষ হিসেবে আজীবন রেকর্ডভুক্ত থাকবে এবং সমাজে কোনো ব্যক্তি ছোটখাটো কোনো অন্যায় করলে কোর্টের জজ ইচ্ছা করলে তাঁকে কোনো প্রকার কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড প্রদান না করে নির্ধারিত সময়ের জন্য তাঁকে এ ধরনের সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবা দানের অনুমতি দিতে পারে, যাতে সে সাজা থেকে মওকুফ পেতে পারে।
আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রচণ্ড। এখানে আনুমানিক ১৫ শতাংশ মানুষের হাতে ৮৫ শতাংশ সম্পদ। ৮৫ শতাংশ মানুষের হাতে ১৫ শতাংশ সম্পদ। ধনীরা ইচ্ছা করলেই ঈদ, বিয়েসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত বা থাইল্যান্ডে উদযাপন করে। বাড়ি বদলালেই তারা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করে বা ফার্নিচার বদলায়। কিন্তু এ ধরনের একটি সংগঠন বা সংগঠিত উদ্যোগের অভাবে ধনী-গরিবের সমন্বয়ে ‘থ্রিফট স্টোর’-এর মতো সংস্থা আমাদের দেশে আজও প্রতিষ্ঠা হয়নি।
দেশে সরকারের সমাজকর্ম, এনজিও ব্যুরোসহ বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে যেসব সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণের সংগঠন আছে, তারা উদ্যোগ নিলে এ রকম জনহিতকর ‘থ্রিফট স্টোর’ অন্তত প্রতিটি বিভাগীয় সদরদপ্তরে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করি। এ রকম সংস্থা গড়তে বেসরকারি দাতার অভাব হবে না, যদি সেটা আমাদের আমলাদের লাল ফিতার বেড়াজালে আটকে না যায়। শুধু প্রয়োজন প্রগতিশীল চিন্তা ও নিবেদিত কামলার মতো উদ্যমী মনোভাব নিয়ে কাজ করার সংকল্প। প্রবীণরা কাজের মধ্যে থাকলে তাদের দেহ, মন উভয়ই ভালো থাকবে; হতাশায় ভুগবে না; প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাববে– ‘ওয়ান মোর ডে ইন প্যারাডাইস’ বা ‘সুন্দর ও কর্মচঞ্চল পৃথিবীতে আরেকটি সুন্দর সকাল!’
ডা. গোলাম শওকত হোসেন: চিকিৎসক, শিক্ষক ও কলামিস্ট
- বিষয় :
- উদ্যোগ