ঢাকা বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

মানবাধিকার সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার যা করতে পারে

মানবাধিকার সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার যা করতে পারে

তানিয়া খাতুন

তানিয়া খাতুন

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৯

গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসকে সম্রাট আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’ ডায়োজিনিস শান্তভাবে বললেন, ‘সামনে থেকে সরো বাপু! তোমার জন্য আমি রোদ পোহাতে পারছি না!’ মানবাধিকার প্রকৃতির মতো। যা তুমি আমাকে দাওনি, তা কেড়েও নিতে পারো না।

পৃথিবীজুড়ে মানবাধিকার রক্ষা ও সমুন্নত রাখতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। সেখানে যে সহজ সত্য স্বীকৃত হয় তা হলো, মানবাধিকারের মূল বিষয় মানুষ। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল– আমাদের অধিকারই আমাদের ভবিষ্যৎ, আর এ অধিকার পেতে হবে এখনই।
বাংলাদেশে এ বছর মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় দেশের তরুণসহ জনসাধারণের জীবন উৎসর্গ ও বৈষম্যমূলক সমাজ গঠনের যে আন্দোলন, তার অনুপ্রেরণায় মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রতিফলন দেখতে পাই। 

অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের বাধা সাইবার নিরাপত্তা আইনের বদলে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’। এর খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে বিতর্কিত ধারাগুলো। বিগত সরকারগুলোর আমলে তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ডিজিটাল, এর পর সাইবার নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়েছেন সব শ্রেণি, বয়স ও পেশার মানুষ। লেখক মুশতাককে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের কারণে জীবন দিতে হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর। এ ছাড়াও ২০১৬ সালে গুমের শিকার সাতক্ষীরার হোমিও চিকিৎসক মোখলেসুর রহমান জনির বৃদ্ধ বাবা-মা এখনও অপেক্ষায়। তারা জানেন না– তাদের ছেলে জীবিত, না মৃত। অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (আইসিপিপিইডি)’ শীর্ষক গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করেছে।  

অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকারের মূল বিষয় মানুষের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সংবেদনশীল হলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনও যথাযথ ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। যেমন বর্তমান সময়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলস্বরূপ গণপিটুনি, পিটিয়ে হত্যা ও সংঘবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চলতি বছরের চার মাসের (আগস্ট-নভেম্বর) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৯৬টি গণপিটুনির ঘটনায় অন্তত ৭৩ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশ এখনও পরিপূর্ণভাবে কাজ করার মতো পরিস্থিতিতে আসেনি এবং নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এর সঙ্গে রয়েছে গণহারে মামলা, গ্রেপ্তার, মামলা-বাণিজ্য, মামলার এজাহারে অধিক সংখ্যায় অজ্ঞাতনামা আসামি।

অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে সহাবস্থানের কথা বললেও বাস্তবে তার যথেষ্ট প্রতিফলন স্পষ্ট নয়। ৩ ডিসেম্বর ফেসবুক পোস্টে আকাশ দাস নামে এক যুবকের কমেন্ট নিয়ে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। পোস্টের পর আকাশকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হলেও হামলার ঘটনায় কোনো মামলার খবর এখনও জানা যায়নি। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্রও রয়েছে। আকাশের গ্রাম মংলারগাঁওয়ে  হামলার ঘটনা ঘটলেও পাশের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম ননিগাঁওয়ে মুসলিম প্রতিবেশীদের প্রতিরোধে হিন্দু বাড়িতে হামলা করতে না দেওয়া যেন মানবিকতার এক দারুণ দৃষ্টান্ত। 
এ অবস্থায় সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ দেশের জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১০টি দাবি পেশ করছি–

১. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো বিষয়ে অভিযোগ থাকলে সে জন্য যথাযথ, আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যেতে পারে। তার বদলে সাংবাদিকদের হয়রানি করা চলবে না। 

২. মতের বৈচিত্র্য নিয়ে যে চর্চা, তার সংস্কৃতিকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে মাজার ও বাউল আখড়ার নিরাপত্তা এবং তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যেন নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

৩. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর অধিকার সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

৪. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি টেকসই বাজার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে জনগণকে স্বস্তি দিতে হবে।

৫. পাইকারি হারে মামলা, গ্রেপ্তার, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এভাবে চললে মানুষের হয়রানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের সুষ্ঠু বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অন্তরায় সৃষ্টি করবে।

৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে যে কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসা চলতেই থাকবে।

৭. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমত প্রদর্শনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, জনতার রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য অভিযোগ প্রমাণের আগেই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে হয়। তার বদলে উস্কানিদাতা ও প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। 

৮. সংসদে উত্থাপিত দীর্ঘ প্রত্যাশিত বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২ আইনে পরিণত করতে হবে।

৯. গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো ও গণপিটুনির পুনরাবৃত্তি রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. জনগণের মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচার এবং কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ সংস্কার জরুরি। এ ক্ষেত্রে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ যে খসড়া করেছে, তা অনুসরণ করা যেতে পারে।

 

তানিয়া খাতুন: লেখক, মানবাধিকারকর্মী
 

আরও পড়ুন

×