সিরিয়া
বাশার আল-আসাদের সঙ্গে সেই ১০ মিনিট
সেলিম জাহান
সেলিম জাহান
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৪
হাফিজ আল-আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৭০ সালে। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং এক হিসাবে বাশার আল-আসাদের ক্ষমতায় আসতে লেগেছিল ৩০ বছর এবং ক্ষমতায় তিনি ছিলেন ২৪ বছর। এই তাঁর আসার ইতিবৃত্ত।
বাশার আল-আসাদের যাওয়ার ইতিবৃত্ত কিন্তু বড় সংক্ষিপ্ত। তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ দিনেই তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। ইরান বা রাশিয়ার মতো বন্ধুরাও তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। ‘য পলায়তি স জীবতি’ বলে তিনি পালিয়েছেন রাশিয়ায়। এই হচ্ছে তাঁর যাওয়ার বৃত্তান্ত।
সেই সিরিয়ায় আমারও যাওয়া-আসার একটি বৃত্তান্ত আছে; তিনটা সংক্ষিপ্ত ভাষ্য বলা চলে। একটি আবার খোদ বাশার আল-আসাদ সম্পৃক্ত। কিন্তু এখন পেছন ফিরে তাকালে পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন মনে হয়।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৯ সালে। আমি তখন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের প্রধান। এক দিন সিরিয়ায় আমাদের আবাসিক প্রতিনিধি ইসমাইল ঔলদ শেখের কাছ থেকে এক চিঠি এসে উপস্থিত। বাশার সরকারের খোদ রাষ্ট্রপ্রধানের দপ্তর থেকে দামেস্কে অফিসে ‘অনুরোধ’ এসেছে, সিরিয়ার জন্য দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি তৈরি করে দিতে হবে। পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, ইউএনডিপির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ভিন্ন অন্য কাউকে পাঠালে হবে না; সিরিয়ার একটা মর্যাদা আছে! সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা তখন ভালো নয়; যাওয়ার ব্যাপারে আমার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু ইউএনডিপির তদানীন্তন প্রশাসক কেমাল দারভিশ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন– আমার না করার উপায় নেই। কেমাল নিজে তুর্কি; বিষয়টির স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সচেতন।
যথাসময়ে পৌঁছা গেল দামেস্কে। বৈরুত থেকে সঙ্গে যোগ দিল আরব আঞ্চলিক দপ্তরের সহকর্মী ও বন্ধু খালিদ আবু ইসমাইল। তুখোড় অর্থনীতিবিদ খালিদ মিসরীয়; সিরিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ও দুর্দান্ত আরবি বলে। পৌঁছানোর পরদিন প্রাথমিক আলাপে দামেস্কে আবাসিক প্রতিনিধির ‘কী যে হয়’ ভাব দেখা গেল। বুঝলাম, বাশার আল-আসাদের দেশে ‘ভীতির সংস্কৃতি’ থেকে বিদেশি প্রতিনিধিদেরও নিস্তার নেই। তাঁকে শান্ত করে আমরা গেলাম পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে।
প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল, মন্ত্রীর মধ্যেও দাম্ভিকতার কমতি নেই। তিনি বললেন, মহামান্য বাশার আল-আসাদ মনে করেন, সিরিয়ায় দারিদ্র্য নেই। তবু পরিকল্পনার প্রয়োজনে কর্মসূচি তৈরি করে দিতে হবে। কিন্তু এটাকে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বলা যাবে না। প্রতিবেদনের কোথাও ‘দারিদ্র্য’ শব্দটির উল্লেখ থাকতে পারবে না। কথা শেষ করে তিনি আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দুই ইসমাইলেরই চোখ-মুখ সাদা হয়ে গেছে। আমি নির্বিকার। প্লেট থেকে আপেলের টুকরো নিলাম। ধীরে-সুস্থে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে স্মিতমুখে বললাম, ‘চমৎকার কফি।’ তারপর বললাম, ‘আমরা তো সিরিয়ার জন্য দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি দেব না; সমৃদ্ধির কর্মসূচি দেব, যেমনটি আপনারা চাইছেন। অসুবিধার কী আছে!’ হৃদ্যের সঙ্গে সভা শেষ হলো। বাইরে এসে খালিদ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কীভাবে এটা করবে?’ হেসে বললাম, “কেন? প্রতিটি বাক্যের প্রকাশভঙ্গি পাল্টে দিয়ে দারিদ্র্যের বদলে ‘সমৃদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করব। একই কথা বলব, কিন্তু উল্টোভাবে।”
পরের বারের অভিজ্ঞতা ২০১৩ বা ২০১৪ সালে। সিরিয়ায় তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। কার্যোপলক্ষেই শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে একটি শিশু শরণার্থীকে দেখে চোখ ফেরাতে পারিনি। ফুলের মতো শিশুটির চোখ চকচক করছে। চুলে তেল পড়েনি বহুদিন; পোশাক শতচ্ছিন্ন; নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে; স্নান হয়নি বহুদিন। এত কিছুর মধ্যেও বুকের কাছে একটি ভাঙাচোরা পুতুল ধরে আছে। জানা গেল, ঘুমের সময় ছাড়া সে পুতুলটি হাতছাড়া করে না।
পিতা জানালেন, পরিবারসহ আলেপ্পো থেকে পালানোর সময় শিশুটি তার পুতুল ছাড়া কিছুই নেয়নি। সারাপথ কচি হাতে পুতুলটি বয়ে এনেছে তুরস্কের সীমান্ত পর্যন্ত। এখন পুতুলটি নিতান্তই ভাঙাচোরা, তবু সে ছাড়বে না। কৌতূহলী হলাম আমি। দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নতুন পুতুল দিলে তুমি এ পুতুলটি দিয়ে দেবে?’ ‘না, না’, ভীষণ জোরে মাথা ঝাঁকায়। তার বাবা জানালেন, এ প্রশ্ন তাকে আগেও করা হয়েছে। কিন্তু তার জবাব একটাই– ‘পুতুলটি আলেপ্পোতে ফেলে আসা বাড়ির দোতলার বারান্দার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে সে পুতুলটি নিয়ে খেলত।’ ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে দেখি, শিশুটি চোখ বুজে পুতুলটির গালের সঙ্গে নিজের গাল মিলিয়েছে। কেন জানি, আমারও চোখ ছাপিয়ে জল এলো। ভাবলাম, অত্যাচারী শাসক মানুষের জীবন কীভাবে তছনছ করে দিতে পারে– বাশার আল-আসাদই তাঁর প্রমাণ।
তৃতীয় ঘটনা ২০১৭ সালের। আমি তখন জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক ও মুখ্য লেখক। মার্চ মাসে প্রতিবেদনের বৈশ্বিক উপস্থাপন হয়ে গেছে সুইডেনে; সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। তারপর নানান দেশের রাজধানীতে দেশ পর্যায়ের উপস্থাপন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা করে থাকেন আবাসিক প্রতিনিধিরা। কোনো কোনো দেশে আমিও যাই। যেমন সেবার গিয়েছিলাম অসলো, হেলসিঙ্কি, কোপেনহেগেন, ভিয়েনা, বার্লিন, রিকাভিক, লন্ডন, ডাবলিন, মানামা, ঢাকা, নাইরোবিতে। দামেস্কে উপস্থাপনের অবস্থা ছিল না। সিরীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত হলো, প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাশার আল-আসাদের হাতে তুলে দেবেন সেখানকার আবাসিক প্রতিনিধি ইয়াকুভ এল হিল্লো।
সংঘাতের কারণে সে বছর সিরিয়ার মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থা খুব খারাপ। ২০১১ থেকে ২০১৭ সালে এসে এ সূচকে মান কমেছে ১৭ শতাংশ। এই সূচক নিয়ে হিল্লো বাশার আল-আসাদের মুখোমুখি হতে চাইলেন না। আবার আমার শরণাপন্ন। গেলাম দামেস্কে। পররাষ্ট্র দপ্তর পই পই করে বলে দিল, আমাদের বরাদ্দ সময় ১০ মিনিট। আমরা প্রাসাদের একটি কক্ষে অবস্থান করব। বাশার আল-আসাদ প্রবেশ করে স্থিত হলে আমি এগিয়ে গিয়ে ১ মিনিট ভূমিকা দিয়ে প্রতিবেদনটি তাঁর হাতে তুলে দেব। তিনি জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাবেন। তারপর তিনি কক্ষ ত্যাগ করলে আমরাও চলে আসব। তিনি প্রশ্ন করলে আমি সংক্ষিপ্ততম উত্তর দেব; তিনি কিছু না জিজ্ঞাসা করলে যেচে কথা বলব না। তিনি করমর্দনের জন্য হাত না বাড়ালে আমি হাত বাড়াব না।
নির্দেশমতো নির্দিষ্ট দিনে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রাসাদের সুসজ্জিত বিশাল কক্ষে আমরা অপেক্ষমাণ। বাশার আল-আসাদ সদলবলে প্রবেশ করলেন। মহড়ামতো আমি এগিয়ে গেলাম। করমর্দনের জন্য তিনি হাত বাড়ালেন। খুব নরম গলায় বললেন, ‘সিরিয়ায় সুস্বাগতম। কেমন আছেন আপনি?’ সূচক নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু কথা বলে প্রতিবেদনটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। যতক্ষণ কথা বলছিলাম, তিনি স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কথা শেষ হতেই তিনি ধন্যবাদ জানালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানব উন্নয়ন সূচকে সিরিয়া এত নিচে নেমে গেল কেন?’ সরাসরি সংক্ষিপ্ততম উত্তর দিলাম, ‘গৃহযুদ্ধ এবং সংঘর্ষের জন্য।’ মাথা নাড়া দেখে মনে হলো, জবাবটা তিনিও জানেন। আবার ধন্যবাদ ও করমর্দন শেষে সদলবলে কক্ষ ত্যাগ করলেন।
এত বছর পরও তাঁর নিষ্পলক, ভাবলেশহীন চোখ দুটোর কথাই মনে আছে। বহু দিন আমার মনে হয়েছে, এমন ঠান্ডা, শীতল, ক্রূর চোখের অধিকারীর পক্ষে সব রকম হিংস্রতাই সম্ভব। সময়ই সেটা প্রমাণ করেছে। সময় এটাও প্রমাণ করেছে– সব সহিংতার প্রতিরোধ আছে এবং একদিন হিংস্রতার ওপরে মানবতারই জয় হয়।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
- বিষয় :
- সিরিয়া