সাক্ষাৎকার: বদরুদ্দীন উমর
দেশে সত্যিকার পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল নেই বললেই চলে
বদরুদ্দীন উমর
সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন ও সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:২৪
বদরুদ্দীন উমর মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও রাজনীতিক এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন। বদরুদ্দীন উমর কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দেন। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। সমকালের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন ও সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।
সমকাল: আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ‘বুদ্ধিজীবী’ কারা, কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
বদরুদ্দীন উমর: বুদ্ধি তো সব মানুষেরই আছে। সব মানুষই বুদ্ধি ব্যবহার করে। এই হিসাবে সব মানুষই বুদ্ধিজীবী। এখানে যাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়, তাদের কি বুদ্ধি বেশি? এ দেশে বুদ্ধিজীবী বলতে সাধারণত যেটা বোঝায়, সমাজ সম্পর্কে যাদের চিন্তাভাবনা আছে; যারা সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা, লেখালেখি করেন। আমাদের দেশের এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তৈরি হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যখন থেকে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন হলো। লেখাপড়া জানা সব লোকই যে সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন, সোচ্চার হবেন– এমন নয়। তাদের মধ্যে যারা সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন তাদেরকেই বুদ্ধিজীবী বলা যায়। তারা লেখক হতে পারেন, সাংবাদিক হতে পারেন, চিত্রশিল্পী হতে পারেন, গায়ক হতে পারেন। এ কথাও বলা দরকার, একেক দেশে বুদ্ধিজীবী একেক রকম হয়।
সমকাল: বুদ্ধিজীবীদের কি শ্রেণিভিত্তি থাকতে পারে?
বদরুদ্দীন উমর: মোটামুটি বলা চলে মধ্য বা উচ্চশ্রেণি। একজন কৃষকের যতই বুদ্ধি থাক, তাকে তো আপনি বুদ্ধিজীবী বলছেন না। আমাদের দেশে শিক্ষা লাভ করে কমসংখ্যক লোক। সাধারণত যে লোক শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি চাকরি করছেন; ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, তাঁকে তো বুদ্ধিজীবী বলে মনে করা হয় না। তারা যদি পেশার বাইরে এসে সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, কথাবার্তা বলেন, লেখালেখি করেন, তখনই তাঁকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত মধ্যশ্রেণি থেকে আসেন।
সমকাল: আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণি-চরিত্রের কি বিবর্তন হয়েছে?
বদরুদ্দীন উমর: বাংলাদেশে যে বুদ্ধিজীবী আমরা এখন দেখছি, তাদের চরিত্র ব্রিটিশ আমল থেকে, এমনকি পাকিস্তান আমলের বুদ্ধিজীবী থেকেও স্বতন্ত্র। কারণ, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন ইংরেজ আমলের শিক্ষিত মধ্য বা উচ্চবিত্ত পরিবারের। তারা সমাজ নিয়ে ভাবতেন, পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। পাকিস্তান আমলেও যারা বিদ্যাচর্চা বা সমাজচিন্তা করতেন, তাদের একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল। চাকরিবাকরি, জমির মালিকানা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পরে নতুন চরিত্রের মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হলো। ১৯৭২ সাল থেকেই ব্যাপক লুটপাট আরম্ভ হলো, চোরাচালান হতে থাকল, শিল্পকারখানা বা ব্যবসা জাতীয়করণ করে আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। এভাবে একটা শ্রেণি, যারা আগের কোনো ভূসম্পত্তির মালিক ছিল না, তারা প্রচুর অর্থ, জমিজমা, ব্যবসা লুটপাট করল। এই যে শ্রেণি বাংলাদেশে তৈরি হলো, এরা এলো লুটপাট ও নানা রকম দুর্নীতির মাধ্যমে। এই মধ্যশ্রেণির মধ্য থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্ম হলো। কাজেই ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে আমাদের এই অঞ্চলে যেসব বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাদের অনেকের খুব দৃঢ় চরিত্র ছিল। বাংলাদেশ আমলের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রের মধ্যে সুবিধাবাদিতা রয়েছে। মধ্যশ্রেণির মধ্যে সাধারণত সুবিধাবাদিতা থাকে। কিন্তু এই মধ্যশ্রেণির মধ্যে চরম সুবিধাবাদিতা আছে। সরাসরি জমি, শিল্পকারখানা, কৃষি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন এবং লুটপাট, চুরি, দুর্নীতির মাধ্যমে গঠিত এমন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি দুনিয়ার কোথাও আছে কিনা, আমি জানি না। এই বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে বলতে হয়, তারা খুব চালাকির সঙ্গে বুদ্ধির ব্যবহার করে জীবিকা অর্জন করেন, ধনসম্পত্তি উপার্জন করেন। সমাজে প্রতিষ্ঠাও লাভ করেন। কারণ মানুষ পরীক্ষা করে দেখে না যে, তাঁর ধনসম্পদ বা প্রতিষ্ঠা কীভাবে এলো। তা ছাড়া তাদের অনেকে প্রচারের ব্যাপারে খুব পারদর্শী।
সমকাল: পাকিস্তান আমলের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক দু’দিন আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। তাদের কারও সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল? কোনো স্মৃতি মনে আছে?
বদরুদ্দীন উমর: আমার সঙ্গে কয়েকজনের যোগাযোগ ছিল। যেমন– মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ডা. ফজলে রাব্বী। শহীদুল্লা কায়সার আমাকে ভাষা আন্দোলনের বই লেখার সময় আর্কাইভ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক দলিলপত্র দিয়েছিলেন। তিনি তখন পার্টির আর্কাইভের দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্র অবস্থা থেকে মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। অনেক সময় দেখা-সাক্ষাৎ হতো। নিজের লেখা অনেক সময় পড়ে, আবৃত্তি করে শোনাতেন। গদ্য রচনা হলেও আবৃত্তি করে শোনাতেন। ডা. রাব্বীর কাছে চিকিৎসার জন্য যেতাম।
সমকাল: একাত্তরের ডিসেম্বরে আপনি কোথায় ছিলেন?
বদরুদ্দীন উমর: একাত্তরের ডিসেম্বরে আমি ঢাকাতে ছিলাম। ২৫ মার্চের পর থেকে মে-জুন পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, যার কথা আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে আছে। কিন্তু জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় থেকেছি।
সমকাল: অনেকে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়েছিল। আপনার মূল্যায়ন কী?
বদরুদ্দীন উমর: জাতি মেধাশূন্য হয়ে গেল কীভাবে? কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু বাকিরা তো ছিলেন। মেধা কি শুধু কয়েকজনেরই ছিল? তাদের হত্যা করার ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ক্ষতি হয়েছে, সেটি ঠিকই। তার মানে এটা নয় যে, তাদের ধরে নেওয়ার ফলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য জাতির মেধা কতটুকু ছিল, সেটা আলাদা কথা।
সমকাল: শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিমুখ কি ভিন্ন রকম হতে পারত?
বদরুদ্দীন উমর: আমি মনে করি না যে, তারা বেঁচে থাকলে বুদ্ধিজীবিতার অভিমুখ যেভাবে আছে তা ভিন্নতর হতো। কারণ তাদের সমসাময়িক ও সমচিন্তার আরও অনেকে বেঁচে ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই এখনকার বুদ্ধিবৃত্তিক অভিমুখ নির্ধারিত হয়েছে। যারা বেঁচে ছিলেন, তারা যে সমাজে কোনো বড় রকমের প্রভাব রাখতে পেরেছেন, এমন নয়।
সমকাল: স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে তাহলে বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকা কেমন ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: বলা দরকার, একটা মানুষের চরিত্র সে কী বলছে, সেটা দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। সে কী করছে, সেটা দিয়ে করতে হবে। শেখ মুজিবের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে, তিনি ১৯৪৯ সাল থেকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, দুঃখ-দুর্দশার কথা; সেগুলো সমাধানে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু দেখা গেল, ক্ষমতার অধিকারী যখন হলেন ১৯৭২ সালে, তখন তাঁর আগের কথাবার্তা এবং পরের কাজের সঙ্গে কোনো মিল নেই। ১০ জানুয়ারি যখন তিনি এলেন; বিমানবন্দরে, রাস্তায়, রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনতা তাঁকে অভিনন্দন জানাল, ভালোবাসা জানাল। কিন্তু তিনি ’৭২ সালে ক্ষমতায় এসে সেই বেচারাদের ওপর আক্রমণ করলেন, রক্ষীবাহিনী করলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন করলেন, দুর্ভিক্ষ আনলেন। আবার এই সাড়ে তিন বছরে এখানকার বুদ্ধিজীবীরা দেখতে পেলেন তাদের সামনে নতুন সুযোগ-সুবিধা। পাকিস্তান আমলে তাদের সামনে তেমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রথমত সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তাদের কোনো ইচ্ছা থাকল না। দ্বিতীয়ত, যাদের মধ্যে প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা ছিল, তারাও নির্যাতনের কারণে কিছু করতে পারেননি। কাজেই স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের কোনো ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না। বুদ্ধিজীবীরা নীরব ছিলেন এবং ব্যক্তিগত জীবন উন্নত করা, বিষয়সম্পত্তি হাসিল করার ব্যাপারে নিবেদিত ছিলেন।
সমকাল: জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের শাসনামলে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কেমন ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের শাসনামলেও কোনো বুদ্ধিজীবী জোরালোভাবে দাঁড়িয়েছিলেন? জিয়া বা এরশাদের শাসনামলে তাদের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না।
সমকাল: এরশাদের পতনকে বুদ্ধিজীবীরা ‘গণতন্ত্রের উত্তরণ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সেটা কতখানি বাস্তব ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: এরশাদের পতনকে বুদ্ধিজীবীরা ‘গণতন্ত্রের উত্তরণ’ আখ্যা দিয়েছিলেন কিনা, আমার ওভাবে মনে নেই। প্রশ্নটা যখন করেছেন তখন বলা দরকার, এরশাদের পতনের পর কী ধরনের সরকার এখানে গঠিত হয়েছিল, সেখান থেকে বোঝা যাবে গণতন্ত্রের উত্তরণ হয়েছিল কিনা। গণতন্ত্রের উত্তরণ মানে এটা নয়, শুধু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা। ৯১ সালে আমরা দেখলাম বিএনপি ক্ষমতায় এলো। এরশাদের আমলে যা ছিল, তার চেয়ে বেশি নির্যাতন তারা করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যাবে, নির্বাচিত সরকারের শাসনামলের চেয়ে জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে অনেক বেশি অধিকার ভোগ করত মানুষ। কয়জন বুদ্ধিজীবী এই কথাটা বলতে পেরেছেন?
সমকাল: তারপর তো এলো শেখ হাসিনার আমল। সেখানে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: শেখ হাসিনার সময়ে বুদ্ধিজীবীরা ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছেন। কে উঠে দাঁড়িয়েছেন? কতজন? এমনকি দেখা যাবে নামকরা সব বুদ্ধিজীবী, লেখক শেখ হাসিনার শাসনামলে একদম চুপ করে ছিলেন; কিছুই বলেননি। পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল যাকে বলে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর মতো এ ধরনের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল নেই বললেই চলে। বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাদের কোনো প্রচার নেই, সেই ধরনের কিছু বুদ্ধিজীবী কোনো কোনো ক্ষেত্রে সোচ্চার থেকেছেন। কিন্তু ওপরতলার বুদ্ধিজীবী বলতে যাদের বোঝায়, তাদের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা দেখা যায় না।
সমকাল: এবারের গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীরা মাঠের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের কর্তৃত্ববাদবিরোধী তৎপরতা কতটা চোখে পড়েছে?
বদরুদ্দীন উমর: কর্তৃত্ববাদবিরোধী বুদ্ধিজীবী কে, কোথায়? প্রথমত, শেখ হাসিনার নির্যাতন এত ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার লোক বিশেষ কাউকে দেখা যায়নি। বরং দেখা যাবে এই বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপকভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করেছেন। আর শেখ হাসিনা নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন চুরি, দুর্নীতির ভাগ দিয়ে মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। বুদ্ধিজীবীরাও সেই ভাগ পেয়েছেন। এই অবস্থায় কর্তৃত্ববাদবিরোধী বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায়, শেখ হাসিনার আমলে তা বিশেষ দেখা যায়নি। বরং বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী সরকারি বুদ্ধিজীবী হিসেবে আরামে থাকতে চেয়েছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের কিছু নয়। বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতা, প্রতিরোধের চেষ্টা ছাড়াই ছাত্ররা জুলাই মাসে দাঁড়িয়েছে, অভ্যুত্থান করেছে। বুদ্ধিজীবীরা যে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, ছাত্ররা সেই কাজ করেছে। অবশ্য তারাও একটা মধ্যশ্রেণির শিক্ষিত অংশ। তাদেরও বলা চলে এক ধরনের বুদ্ধিজীবী।
সমকাল: কিছু বুদ্ধিজীবী, সংখ্যায় সামান্য হলেও কিন্তু এবারের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন, রাস্তায় নেমেছেন।
বদরুদ্দীন উমর: হ্যাঁ, সামান্য কিছু সম্মানিত লোক অবশ্যই থেকেছেন। বুদ্ধিজীবীদের সবাই যে সুবিধাবাদী, এমনটা নয়। কিন্তু অধিকাংশই সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকেছেন। শেখ হাসিনার আমলে, তার আগেও এবং এখনও।
সমকাল: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সামাজিক পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন না কেন?
বদরুদ্দীন উমর: এই বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনভাবে দাঁড়াবেন কীভাবে? কেননা, আগেই যেটা বললাম, তাদের যে অর্থনৈতিক ভিত্তি, তাতে স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখার কোনো ক্ষমতাই নেই। কারণ, তারা যে শ্রেণির অংশ, সেই শ্রেণির স্বাধীন ভূমিকা রাখা সম্ভবই নয়। তারা হচ্ছেন এমন একটি শ্রেণির অংশ বা অধীন, যেটি ’৭২ সালের পর থেকে লুটতরাজের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
সমকাল: বাংলাদেশের মতো একসময়ের উপনিবেশ শাসিত রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
বদরুদ্দীন উমর: বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আলাদা হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সবার চিন্তা হওয়া উচিত যেন মানুষের কল্যাণ হয়, মানুষ খেতে পায়, তাদের কাজকর্ম থাকে, তাদের শিক্ষা থাকে, চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকে।
সমকাল: এই সময়ের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
বদরুদ্দীন উমর: গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এখানে একটা নেতৃত্ব দেখা দিয়েছে বা তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীসুলভ একটা আচরণও দেখা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ আমলে যেসব বুদ্ধিজীবী সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন, তরুণরা তাদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং তাদের মধ্যে সততা বেশি।
সমকাল: আপনার নিজের চিন্তা ও তৎপরতার প্রভাব তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কতটা দেখেন?
বদরুদ্দীন উমর: আমার চিন্তা ও তৎপরতার প্রভাব কী, এসব বলতে চাই না। একটা জিনিস হচ্ছে, আমি কোনো ক্ষমতাসীন শক্তির সঙ্গে আপস করিনি। পাকিস্তান আমলেও করিনি, বাংলাদেশের কোনো আমলেই করিনি। আমি কারও কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধা নিইনি। ক্ষমতাসীনদের নির্যাতন, নিপীড়ন, জনবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে আমি সবসময় কথা বলেছি। এই কথা বলতে গিয়ে কী বিপদ হবে, এসব চিন্তা কখনোই করিনি। আমার দিক থেকে আমি এই কাজ করেছি। তরুণ বুদ্ধিজীবী মহলে তার কতটা প্রভাব পড়েছে, আমি বলতে পারব না। কারণ সবসময়ই দেখেছি, আমি যে এত লেখালেখি করেছি, কাজ করেছি, তার কোনো আলোচনাই এসব বুদ্ধিজীবীর মধ্যে নেই। তারা আমার ক্ষেত্রে এক ধরনের নীরবতা পালন করে এসেছেন।
সমকাল: কন্সপিরেসি অব সাইলেন্স?
বদরুদ্দীন উমর: যেহেতু আমি যেসব কথা বলেছি, সেগুলো খণ্ডন করার মতো অবস্থা সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের নেই, সে জন্য তারা নীরবতা অবলম্বন করে আমাকে শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নীরবতা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও আমি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। এর প্রভাব অন্য বুদ্ধিজীবী মহলে পড়েছে কি না পড়ছে, এটা আমি বলতে পারব না। অন্যরা ঠিক করবে।
সমকাল: জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নীরবতার ষড়যন্ত্র খানিকটা দূর হয়েছে কিনা?
বদরুদ্দীন উমর: হতেই পারে, এমন একটা অভ্যুত্থানের পরে সমাজের যে পরিবর্তন হয়েছে, সেই পরিবর্তনের প্রভাব সমাজের সবার ওপরে পড়ছে; সমাজের চিন্তাভাবনার ওপর পড়ছে। বুদ্ধিজীবীদের ওপরও পড়তে পারে। কিন্তু এখানে কোনো বিপ্লব হয়নি। শ্রেণির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে শ্রেণি থেকে আওয়ামী লীগ এসেছে, সেই শ্রেণি থেকেই বর্তমান সরকার এসেছে। বিএনপিও একই শ্রেণি। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের ফলে যেটা হয়েছে, মাইন্ডসেটের মধ্যে পরিবর্তন। পরবর্তীকালে যারাই আসুক, তারা বুঝবে– শেখ হাসিনা যেভাবে কাজ করেছে, সেভাবে করলে টিকে থাকা যাবে না।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার