অন্যদৃষ্টি
গারো সংস্কৃতিতে পরিবর্তন
প্রতীকী ছবি
মেজবাহ উদ্দিন তুহিন
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী গারো জনপদে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। পাহাড়ি অরণ্য, নদী, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্বতমালাকে কেন্দ্র করে নিভৃত পরিবেশে এক সময় বাংলাদেশের গারো জনপদ গড়ে উঠলেও বর্তমানে নানা সংস্কৃতির প্রভাব ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন তাদের সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। পরিবর্তন এসেছে তাদের জনজীবন ও খাদ্যাভ্যাসে।
বাংলাদেশে তাদের আগমনের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। গারো সম্প্রদায় মঙ্গোলীয় নর সমাজের উত্তর শাখার মানব সম্প্রদায়ের তিব্বতি বর্মণ শ্রেণির একটি অংশ বলে মনে করা হয়। অনেক গবেষকের মতে, ৩ থেকে ৫ হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে গারোদের আগমন ঘটে। প্রথমে তারা তিব্বতের উত্তর এলাকা ও পশ্চিম-উত্তর চীনের চিংহায় প্রদেশের কোকনর হ্রদের উত্তর-পূর্ব তীর থেকে হিমালয়ের দুর্গম গিরিপথে অগ্রসর হয়ে ভুটানের নকশালবাড়ী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। সেখান থেকে আসাম, কামরূপ প্রভৃতি স্থান ঘুরে গারো পাহাড়ে নিজেদের বসতি গড়ে তোলে। পরে অষ্টম-নবম শতাব্দীর দিকে বাংলাদেশের উত্তর সীমানায় পাহাড়ের পাদদেশে গারোরা বসবাস শুরু করে বলে ধারণা করা হয়। অপর এক দল তিব্বত থেকে সিকিমের গিরি খাত হয়ে ভারতের কোচবিহারে এসে সেখানে এবং বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।
পাহাড়ে এবং পাদদেশে এক সময় তারা জুম চাষ করত। ভালো কৃষির জন্য প্রতিবছর ওয়ানগালা নামক উপাসনা করত। ফসল কাটা এবং পাহাড় ও মাঠ থেকে কিছু সংগ্রহ করার জন্য বাঁশের তৈরি জোঙ্গায় গাছের ছাল বেঁধে তা কপালে ঝুলিয়ে মাইলের পর মাইল পথ বয়ে চলায় অভ্যস্ত। পশুপাখি শিকারে ঘুরে বেড়াত। নারী-পুরুষ সমানভাবে ক্ষেত-খামারে কাজ করত। এক সময় পাহাড় কেটে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। তাদের শরীরের গঠন পরিশ্রমী হতে সহায়তা করেছে।
তাদের জীবনাচারে নিজস্ব সত্তার প্রতিফলন পাওয়া যায়।
গারোরা এক সময় বিস্তৃত জঙ্গলে সীমারেখাহীন ইচ্ছামতো স্থানে বসবাস করেছে। সে সময়ে তাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা ছিল না। তারা বন-বাদাড়ে চরে বেড়িয়েছে। কোনো এক সময়ে এসে ধর্ম, ভাষা, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পরিকল্পিতভাবে বসতি নির্মাণ, বিয়ে, শ্রেণি-গোত্র-উপগোত্র, সামাজিক সম্পর্ক ও নানা মূল্যবোধের বন্ধনে আচ্ছাদিত হয়ে তৈরি হয় তাদের সমাজ ব্যবস্থা। গড়ে ওঠে কৃষ্টি-কালচার, নিয়ম ও প্রথা। ক্রমে নানা উৎসব, নাচ-গান, সামাজিক অনুষ্ঠান ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-জীবিকায় সমৃদ্ধি লাভ করে।
গারো পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। এ সমাজে সাধারণত পরিবারের ছোট মেয়ে সমুদয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তাকে নকনা (পরিবারের দায়িত্ব পালনকারী) বলা হয়। নকনার স্বামীকে বলা হয় নক্রম। পরিবারের সব দায়দায়িত্ব এবং পিতামাতার সেবাযত্ন, ভরণপোষণ ও দেখভালের দায়িত্ব নকনা-নক্রমের।
গারোরা নিজেদের অস্তিত্ব, সচেতনতা ও স্বতন্ত্র সম্পর্কের জন্য অনেক বেশি শক্তিশালী থাকলেও আজকের এই সময়ে পরিবেশ-পরিস্থিতির নানা পরিবর্তন, বনভূমি হ্রাস, জমি থেকে উচ্ছেদ, সরলতা, দুর্বলতা এবং দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে আদি ঐতিহ্যের এই জাতির অনেকেই হারিয়েছে নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক নিয়মনীতি। সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে খ্রিষ্টান মিশনারিরা। সুযোগ বুঝে তারা অষ্টাদশ শতকে এ অঞ্চলে গড়ে তোলে মিশনারি। ইউরোপীয় উন্নত চিন্তা ও আগ্রাসী প্রচারণায় মিশনারি তৎপরতা তাদেরকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে। বর্তমানে তারা নিজেদের ভাষা হারিয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলে।
ভিন্ন সংস্কৃতি তাদের আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত করেছে, কিন্তু ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পরিবর্তন ঘটেছে খাদ্যাভ্যাস ও পোশাকের ক্ষেত্রে। ধর্মের পরিবর্তনও আলোিত হচ্ছে। তাদের নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু তাদের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যে ভরপুর জীবনপ্রণালি ও প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে উন্নয়নের আড়ালে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন সচেষ্ট আদি ঐতিহ্য রক্ষায়।
ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন: গবেষক ও লেখক, আঞ্চলিক পরিচালক, বাউবি
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি