ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

ফিলিস্তিন

এতক্ষণে নিউইয়র্ক টাইমস কহিলা বিষাদে

এতক্ষণে নিউইয়র্ক টাইমস কহিলা বিষাদে

রবার্ট ইনলাকেশ

রবার্ট ইনলাকেশ

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৩:১৩

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা স্বীকার করেছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপক মাত্রায় ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ বা ঘটনাচক্রে অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসসাধন করেছে। এটি উন্মোচন করলেও পত্রিকাটি আগে প্রকাশিত প্রধান প্রধান পরিসংখ্যান গোপন করেছে।

২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত খবরটিতে ইসরায়েলি এক আদেশের কথা বলা হয়, যেখানে হামাসের নিম্ন পর্যায়ের প্রতি নেতা বা কর্মীকে হত্যার প্রয়োজনে ২০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়। নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের সামরিক ইতিহাসে এমনতর আদেশের কোনো নজির নেই।’

তবে ২০২৪ সালের এপ্রিলের শুরুতে, +৯৭২ ম্যাগাজিন নামে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যম শুধু ইসরায়েলের সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে বাস্তব সত্যই প্রকাশ করেনি, একই সঙ্গে ‘গ্রহণযোগ্য’ কোলাটেরাল ড্যামেজে কেমন ক্ষতি হয়েছে, তার পরিসংখ্যানও দিয়েছে। +৯৭২-এর নিবন্ধে প্রকাশ হয়েছে যে, ইসরায়েলি যে বিমান হামলায় হামাসের শুজাইয়া ব্যাটালিয়ন কমান্ডার উইসাম ফারহাতকে হত্যা করেছে, সেখানে ১০০ বেসামরিক লোককে হত্যা করার জন্য অনুমোদন ছিল। হামাসের সেন্ট্রাল গাজা ব্রিগেডের কমান্ডার আয়মান নোফালের হতাশাজনক ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক ছিল; যেখানে সূত্র অনুসারে, ইসরায়েলি ‘সেনাবাহিনী প্রায় ৩০০ বেসামরিক লোককে হত্যার অনুমোদন দিয়েছে’।

+৯৭২ প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গক্রমে নিউইয়র্ক টাইমস উল্লেখ করলেও সতর্কতার সঙ্গে এটি বলেছে যে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এটি অস্বীকার করেছিল। এ বিষয়ে +৯৭২ ম্যাগাজিনের অনুসন্ধানী কাজ এপ্রিলে শুরু হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রথম প্রকাশিত নিবন্ধের অংশে সূত্র থেকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে, আগের অপারেশনগুলোতে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ওপর হামলায় কোলাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে কয়েক ডজন বেসামরিক মৃত্যু হয়েছে, যা অনুমতিপ্রাপ্ত মৃত্যুসংখ্যা থেকে অনেক বেশি। বস্তুত এসব অপারেশনে শত শত বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

বাস্তবে এত বেশি সংখ্যক কোলাটেরাল ড্যামেজে মৃত্যুর পরও কীভাবে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের সামরিক ইতিহাসে এমন নজির নেই’? ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বছরের পর বছর ধরে জেনেশুনে বেসামরিক লোকদের কোলাটেরাল ড্যামেজের নামে হত্যা করে চলেছে। 

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর আগের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য জাতিসংঘের যে কোনো প্রতিবেদন আক্ষরিক অর্থে দেখতে হবে। এমন নয় যে, ইসরায়েল শুধু গাজাতেই ৯ ধরনের ভয়াবহ 

‘কোলাটেরাল ড্যামেজের’ নামে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। এটিকে তারা এক ধরনের স্বাভাবিক বা সাধারণ বিষয়ে পরিণত করেছে, এমনকি লেবাননেও তারা এভাবে মানুষ হত্যা করেছে। ইসরায়েল যখন হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে, তখন তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল যে, দক্ষিণ বৈরুতে বেশ কয়েকটি বেসামরিক ভবন ধসে ফেলার কারণে মোট মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩০০ হবে। 

নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে আক্ষরিক অর্থে নতুন কিছুই নেই; তারা এমন কিছু নিশ্চিত করে, যা ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। তবুও মূল বিষয় বাদ দিয়ে এবং পুরোনো পরিসংখ্যানের পুনরাবৃত্তি করে পত্রিকাটি হত্যাকাণ্ডকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে মানুষ কম ক্ষুব্ধ হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পত্রিকাটি প্রমাণিত সত্য হিসেবে এ অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে যে, হামাস উদ্দেশ্যমূলকভাবে বেসামরিক নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের বাঁচাতে চায়, যদিও এ বিষয়টি নিয়ে এর আগেও প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে।

তবে এটি অনস্বীকার্য যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। পুরো যুদ্ধে তারা যে ব্যাপকভাবে এটি করছে, তার প্রমাণ হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এটি ইসরায়েলের সামরিক ডকট্রিন তথা মতবাদে স্বীকৃত। নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষ্য হলো, ‘২০২৩ সালের নভেম্বরের পর থেকে বৈশ্বিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও ইসরায়েল গোলাবারুদ সংরক্ষণ করতে শুরু করে এবং তার কর্মকাণ্ডে কিছু নিয়ম কড়া করে, যার মধ্যে এমন বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা অর্ধেক করে দেওয়া, যারা নিম্নপদস্থ জঙ্গিদের আক্রমণ করার সময় বিপন্ন হতে পারে, অথচ তারা কোনো হুমকির কারণ নয়।’ এখানে প্রশ্ন হলো, এই তথ্য এলো কোথা থেকে? নিবন্ধে বলা হয়েছে, সূত্রগুলো সবাই ইসরায়েলি সেনা ও কর্মকর্তা। অর্থাৎ ইসরায়েলিদের কথাই শুধু প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে কি কোনো বিশ্লেষণ করা হয়েছে বা উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেটি প্রমাণ করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসের নিম্ন পর্যায়ের যোদ্ধাদের জন্য গড়ে ১০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করতে পারবে? একদমই না, কারণ ইসরায়েলও জনপরিসরে এ তথ্যটি উপস্থাপন করতে পারে না, এমনকি হাজার হাজার কথিত ‘হামাস যোদ্ধার’ নামও তারা উল্লেখ করতে পারে না, যাদের তারা ইতোমধ্যে নিশানা করেছে।

কথিত হামাস জঙ্গিদের নিহত হওয়ার যে সংখ্যা ইসরায়েল সরকারিভাবে উল্লেখ করছে, আমরা যদি তার পরিসংখ্যান দেখি, তবে স্পষ্ট যে, এটি জাতিসংঘের মৃতের হিসাবের সংখ্যার সঙ্গে মেলে না। গাজায় সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার, যেখানে ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ ও মৃত বলে অনুমান করা হয়। তাহলে ইসরায়েলি পরিসংখ্যানে ‘হামাস যোদ্ধা’র সংখ্যা কত? হামাস যোদ্ধাদের ব্যাপারে ইসরায়েলের যে দাবি মৃতের সংখ্যা বেশি হবে, এটি গ্রহণ করার অর্থ হলো নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি। তাদের তখন স্বীকার করতে হবে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে শুধু হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়। এর বাইরেও ৩ এপ্রিল +৯৭২ ম্যাগাজিনের নিবন্ধটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে। এটি নির্দেশ করে যে, ছোটখাটো হামাস নেতাদের নিশানা করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রকৃতপক্ষে আরও ভয়ংকর অনিয়ন্ত্রিত প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। কারণ ‘আপনি গুরুত্বহীন লোকেদের জন্য ব্যয়বহুল বোমা নষ্ট করতে চান না।’
নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে কোথাও কোনো সামরিক নিশানার কিছু না থাকলেও, বেসামরিক লোকদের হত্যার কথা উল্লেখ নেই। এমনকি সৈন্যদের গণনির্যাতন, যৌন নির্যাতন বা বাড়িঘর ভেঙে ফেলার কথাও উল্লেখ নেই। হামাসের নেতৃত্বাধীন ৭ অক্টোবরের হামলার পর সব কিছুই সামরিক বাহিনীর ফ্রেমে বর্ণনা করা হচ্ছে, কারণ হামাসের হামলাকেই তারা শুধু ভয়াবহ মনে করছে।

রবার্ট ইনলাকেশ: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক; আরটি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক 

আরও পড়ুন

×