ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

স্ত্রীরোগ সেবার প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর সময় এখনই

স্ত্রীরোগ সেবার প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর সময় এখনই

প্রতীকী ছবি

ডা. সাবরীনা জাবীন, এ এস এম রিয়াদ আরিফ ও মাহিউর রহমান

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৩:২০

নারীর সমগ্র জীবনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেবল কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়; সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা সেবা অঙ্গাঙ্গী জড়িত। তবে বাস্তবতা হলো, স্ত্রীরোগ নারীর জীবনচক্রের প্রতিটি পর্যায়ে অপরিহার্য হলেও আজও তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে কম অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়গুলোর একটি। ফলে প্রতিবছর লাখ লাখ নারী তাদের শারীরিক সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বিশেষত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এর প্রভাব আরও গভীর। 

বিশ্বব্যাপী স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা নারীদের জীবনের ওপর কী পরিমাণ প্রভাব ফেলছে তা উঠে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিকসে প্রকাশিত ২০২৩ সালের এক গবেষণায়। গবেষণার ফল অনুযায়ী, প্রতিবছর ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে কেবল স্ত্রীরোগজনিত সমস্যার কারণে বিশ্বব্যাপী ১৪.৫ মিলিয়ন কর্মবছর নষ্ট হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে এ পরিস্থিতি আরও জটিল। এখানে গ্রামীণ এবং নিম্ন আয়ের নারীরা প্রায়ই দরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ফলে এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে, যা উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। এ দেশের প্রেক্ষাপটে মহিলাবিষয়ক সেবাকে কেবল গর্ভকালীন বা গর্ভ-পরবর্তী সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করা হয়। কিন্তু স্ত্রীরোগ সেবা একজন নারীর জীবনের সব পর্যায়েই অর্থাৎ জীবনচক্রজুড়ে দরকার। 

আইসিডিডিআর,বির ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ‘এসেনসিয়াল গাইনোকোলজিক্যাল স্কিলস (ইজিএস)’ নামে একটি গবেষণাধর্মী প্রকল্পের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, গ্রামীণ অঞ্চলে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অভাবে বহির্বিভাগে মানবসম্পন্ন স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ অনেক কম। ফলে প্রতিবছর সেবাপ্রাপ্তির অভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকে ভুগতে হয়। 

নারীর জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই স্বাস্থ্যসেবা অপরিহার্য। কিশোরী বয়সে মাসিকজনিত সমস্যার সমাধান, প্রজনন বয়সে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (পিসিওএস) এবং বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা, মেনোপজ-পরবর্তী বয়সে হৃদরোগ ও হাড় ক্ষয়ের মতো জটিলতার প্রতিরোধ– সর্বক্ষেত্রে এই সেবা প্রয়োজন। এ ছাড়া হরমোনাল ইমব্যালান্স, শরীরে লোম বেড়ে যাওয়া, মাসিক-সংক্রান্ত অসংখ্য সমস্যার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। কিন্তু অনেক নারী এই বিষয়ে সামাজিক লজ্জা বা অজ্ঞতার কারণে চিকিৎসা নিতে চায় না। যেমন জেনিটাল প্রোলাপস বা ফিস্টুলার মতো সমস্যাগুলো নারীর দাম্পত্য ও মানসিক জীবনে প্রভাব ফেলে থাকলেও সঠিক সেবা গ্রহণে তারা অনাগ্রহ দেখায়। মূলত লোকলজ্জা এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য কোথায় যেতে হবে, সেই বিষয়ে অজ্ঞতা থেকে তারা চিকিৎসাসেবা গ্রহণে আগ্রহ পায় না। নারীর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এই গোপনীয়তা ভাঙা দরকার। এ জন্য প্রয়োজন পরিবারের সবার সচেতন হওয়া। গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি নারীর অন্য পর্যায়ের স্বাস্থ্যের প্রতিও নজর দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমাদের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নন কিন্তু চিকিৎসক– এমন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত যেন তারা বহির্বিভাগে আগত রোগীদের প্রাথমিকভাবে স্ত্রী রোগের চিকিৎসা এবং যথাযথ রেফারেল করতে পারেন।

আমাদের দেশে নারীর জন্য সেবাপ্রাপ্তি তার দোরগোড়ায় নেই। তাই নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। আইসিডিডিআর,বির ‘এসেনসিয়াল গাইনোকোলজিক্যাল স্কিল’ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প এর মাঝে প্রাথমিক সফলতার আভাসও দিচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় যারা প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষায়িত নন, এমন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে নারীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সহজ হচ্ছে। 

বাংলাদেশ মাতৃ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি সাধন করলেও স্ত্রীরোগ-বিষয়ক সেবা প্রদানে এখনও পিছিয়ে। সমন্বিতভাবে একজন নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দক্ষ সেবাদানকারী, সুসংগঠিত রেফারেল পদ্ধতি, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের জন্য স্ত্রীরোগ সেবাকেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। 

নারীর জীবনচক্রের সব পর্যায়ে যথা– শৈশব, কৈশোর, যৌবন, গর্ভকাল এবং বৃদ্ধ বয়সে পুষ্টি, সর্বোচ্চ মানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে নারীর সমগ্র জীবনের সব চক্রের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা সংকট থেকে উত্তরণে সচেতনতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ এলাকায় সেবাকেন্দ্র স্থাপন, সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবনী সমাধান নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও সমাজের সর্বস্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা মানে একটি সুস্থ, কর্মক্ষম এবং সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলা।

ডা. সাবরীনা জাবীন, অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট; এ এস এম রিয়াদ আরিফ, সিনিয়র কনটেন্ট ডেভেলপার; মো. মাহিউর রহমান, স্টাডি ফিজিশিয়ান, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, আইসিডিডিআর,বি
asm.arif@icddrb.org

আরও পড়ুন

×