নির্বাচন
ভোটার হওয়ার বয়স কমানোর ঝক্কি-ঝামেলা
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৩:২২
অ নেক সংস্কার প্রস্তাবের ভেতর উচ্চারিত হলো ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ হওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই সে প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত দু’দিনব্যাপী জাতীয় সংলাপে। তিনি বললেন, যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি। তাই তিনি মনে করেন, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের মানুষ ১৯৩৭ সালে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, তবে তাতে গরিব মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের (চৌকিদারি) কর প্রদানকারী ব্যক্তিই কেবল ভোট দিতে পারত। করদাতা হিসেবে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ভারতের মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার পায়। এই বিধান ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ২১ বছর বয়সে সর্বজনীন ভোটের অধিকার নির্ধারিত হয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর করা হয়। হয়তোবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতার শেষ লাইন ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’ প্রভাব বিস্তার করেছিল। অথচ বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে ভোটারের বয়স ১৮-তে নামিয়ে আনা হয় ১৯৮৯ সালে।
সারাবিশ্বে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভোটার হওয়ার বয়স ২৫ বছর। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ডটকমের মতে, পৃথিবীর ২৩৬টি দেশের মধ্যে ২০৭টি দেশে ১৮ বছর বয়সের নাগরিকরা ভোটাধিকার লাভ করে। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতসহ সার্কভুক্ত দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ নির্ধারিত। ক্যামেরুন, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুরসহ আটটি দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ২১ বছর হলেও বাহরাইন, নাউরু ও তাইওয়ানে ভোটার হওয়ার বয়স ২০ বছর। অন্যদিকে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় ভোটার হতে হলে ১৯ বছর বয়স হতে হয়।
পৃথিবীর ছয়টি দেশ– পূর্ব তিমুর, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া, সাউথ সুদান ও সুদানে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর। ইন্দোনেশিয়ায় ১৭ বছর বয়সের আগে বিবাহিত হলেও ভোটার হওয়া যায়। সর্বনিম্ন ১৬ বছর বয়সে ভোটার হওয়া যায় অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, কিউবা, ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া, নিকারাগুয়া, স্কটল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। ২০১৪ সালে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের সময় প্রস্তাবের পক্ষে বেশি ভোট পাওয়ার প্রত্যাশায় স্কটল্যান্ডে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে ১৬-তে নামিয়ে নেওয়া হয়।
ভোটার হওয়ার বয়সকে একটি গাণিতিক সংখ্যা মাত্র মনে করলে সেটি হ্রাস-বৃদ্ধিতে সমস্যা নেই। ভোটার হওয়ার বয়সের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনেক কিছু জড়িত। আমাদের দেশে নারীর বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮। ভোটদানের বয়স নামিয়ে আনলে নারীর বিয়ের বয়সও নামিয়ে আনার দাবি উঠবে। যে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে মত দিতে পারবে; বিয়ের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে অবশ্যই মতামত দেওয়ার অধিকার সে সংরক্ষণ করে বলে দাবি করতে পারে। দেশে নানা পক্ষ নারীর বিয়ের ক্ষেত্রে ‘গৌরী’ শিশু পছন্দ ও বিয়ের পক্ষে অভিমত দিয়ে আসছে। দেশের জনসংখ্যা সীমিত করার পরিবর্তে উদার বৃদ্ধি করতে চাইলে ভোটারের বয়স কমানো তাদের জন্য একটি মোক্ষম হাতিয়ার হতে পারে।
একজন ব্যক্তির অনুকূলে সম্পত্তির উইল সম্পন্ন হলেও উত্তরাধিকার আইন-১৯২৫ অনুসারে ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত সেই ব্যক্তির অনুকূলে উইলের প্রবেট দেওয়া হয় না। ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত যে ব্যক্তি নিজের সম্পত্তির ওপর আইনি অধিকার লাভ করতে পারে না, সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রের ওপর অধিকার লাভ করে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে পারে কিনা– তা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে।
আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তি শিশু। একটি শিশু দেশের আইনকানুনের আলোকে বেশ কিছু সুবিধা পায়। বর্তমানে ১৮ বছরের কম বয়সী কেউ ফৌজদারি অপরাধ করলে সাধারণ আদালতের পরিবর্তে শিশু আদালতে বিচারের সুবিধা লাভ করে। বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা, নিরাপদ পানি, বিনোদন, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির মৌলিক অধিকার রয়েছে। সরকারও এই সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিদ্যমান সময়ের এক বছর আগে শিশুরা ভোটার হলে অন্তত ৩০ লাখ ব্যক্তির জন্য এ সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রকে আর ভাবতে হবে না।
১৯৭১ সালে ১৪-১৫ বছর বয়সের শত শত শিশু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করলেও সেনাবাহিনীতে তাদের আত্তীকরণ হয়নি বা সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের বয়স ১৪ বা ১৫-তে নামিয়ে আনা হয়নি। পেনশনযোগ্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এখন কি সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী বা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স কমিয়ে আনার কথা বিবেচনা করা হবে? ড্রাইভিং লাইসেন্স, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স, ব্যাংক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও বয়সের নিম্নসীমা কমিয়ে আনার দাবি উঠবে ভোটার হওয়ার বয়স কমার ডামাডোলে। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের সফল অভ্যুত্থান সম্পন্ন করার বিনিময়ে তাদের শৈশব কেড়ে নিয়ে ভোটার করা যতটা সংগত, তার চেয়ে বেশি সংগত হতে পারে তাদের প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া। বৃত্তি দিয়ে উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া তাদের জন্য ভালো উপহার হতে পারে।
অনুষঙ্গ হিসেবে প্রার্থিতার বয়স নিয়েও কথা ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় দাবি জনপ্রতিনিধিদের কমপক্ষে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। ক’দিন আগেই বাংলাদেশ উত্তাল হয়েছিল শিক্ষার্থীরা বিলম্বে গ্র্যাজুয়েট হয় বলে চাকরিতে যোগদানের সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ নির্ধারণের দাবিতে। সেখানে প্রার্থিতার বয়স ২১ বছরে নামিয়ে আনার দাবি গ্র্যাজুয়েট জনপ্রতিনিধির ধারণার বিপরীত। ব্যক্তিগতভাবে কেউ গ্র্যাজুয়েট না হলেও ২৫ বছর গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার বয়স। তাই জনপ্রতিনিধিদের প্রার্থিতার বয়স বিদ্যমান ২৫-ই শ্রেয়।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
- বিষয় :
- নির্বাচন