সবজি চাষির আর্তনাদ
সমাধানের পথ হিসেবে কিছু প্রস্তাব
ফাইল ছবি
তালহা জুবাইর মাসরুর
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫০
শীতকাল মানেই দেশের কৃষি খাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার। বগুড়ার মহাস্থান হাট, দিনাজপুর, নাটোর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ সময়ে উৎপাদিত সবজির সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যায়। এ অতিরিক্ত সরবরাহের সুফল ভোক্তারা অনেকাংশে পেলেও কৃষকের জন্য তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বগুড়ার মহাস্থান হাটে ফুলকপি ১-৪ টাকা কেজি এবং মুলা ২-৫ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে, যা কৃষকের উৎপাদন খরচের চেয়েও কম।
চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন শুধু নয়, মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যও সমস্যার বড় একটি কারণ। দেশে আধুনিক হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের অভাবে কৃষকরা তৎক্ষণাৎ ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। আছে কৃষিপণ্য দ্রুত পরিবহন এবং সুষ্ঠু বিপণনের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাব। ‘কৃষক সুরক্ষা’ নামে একটি মডেল বাস্তবায়ন করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এ মডেল সফলভাবে কার্যকর করতে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন:
১. ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস-এমএসপি) নির্ধারণ
সরকারের উচিত উৎপাদন খরচ, বাজারের চাহিদা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকের ভিত্তিতে প্রতি মৌসুমে প্রধান কৃষিপণ্যের একটি ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করা। এই ন্যূনতম দাম কৃষকদের একটি আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করবে এবং বাজারে দর পতনের সময় তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের এমএসপি মডেল কৃষকদের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে।
২. উপজেলা পর্যায়ে কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন
প্রতিটি উপজেলায় একটি আধুনিক কৃষিপণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি, যেখানে কৃষকরা সরাসরি উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসবেন। পণ্যের গুণগত মান যাচাই শেষে এমএসপি বা স্থানীয় বাজারমূল্য অনুসারে তা গ্রহণ করা হবে। সংগৃহীত পণ্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে বা সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে পাঠানো হবে। রপ্তানিও করা যেতে পারে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং কৃষক সরাসরি লাভবান হবেন।
৩. হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন
উৎপাদন অঞ্চলের কাছাকাছি আধুনিক বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেদারল্যান্ডসের মতো আধুনিক হিমাগার এবং
প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে মৌসুমি পণ্যের অতিরিক্ত
সরবরাহের কারণে দাম পড়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধান করা যাবে। যেমন– টমেটো থেকে সস বা পিউরি তৈরি করে স্থানীয় বাজার ছাড়াও রপ্তানি করা যায়। তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়ার উদ্যোগ নিলে বিষয়টা আরও গতিশীল হবে।
৪. ডিজিটাল এগ্রো-মার্কেটপ্লেস চালু করা
কৃষকরা যাতে সরাসরি ভোক্তা, পাইকার এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, সে জন্য একটি আধুনিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষক তাদের পণ্য তালিকাভুক্ত করে সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক নিলামের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করলে তা বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। ভারতের ই-নাম (ইলেকট্রনিক ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট) মডেল এর উদাহরণ হতে পারে। এ মডেল অনুসারে, একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যেখানে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তা, পাইকার ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
৫. কৃষিবীমা ও ক্ষুদ্রঋণ স্কিম
ফসলের অতিরিক্ত উৎপাদন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন– বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়) এবং বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষকরা যাতে ক্ষতির শিকার না হন, সে জন্য বীমা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রতিটি প্রধান ফসলের জন্য পৃথক বীমা পরিকল্পনা থাকবে। বীমার আওতায় ফসলের উৎপাদন খরচ, বাজারমূল্য পতনের ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্টের ঝুঁকি কভার করা হবে। বীমা স্কিমের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাও সংযুক্ত করা যাবে। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে এবং জামানত ছাড়া ঋণের ব্যবস্থা থাকবে। ঋণ পরিশোধের সময় পণ্যের বিক্রি থেকে অর্জিত আয়ের ওপর নির্ভর করবে, যা কৃষকের জন্য সহজবোধ্য ও চাপমুক্ত হবে। বীমা এবং ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হবে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রপ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রাম অনুসরণ করা যায়।
৬. রপ্তানি বৃদ্ধি
রপ্তানিযোগ্য পণ্য চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য মানসম্পন্ন প্যাকেজিং এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে। থাইল্যান্ডের রাইস এক্সপোর্ট মডেল এ ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত। এ জন্য শ্যামপুর কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসকে আরও কার্যকর করা দরকার। এখানে আধুনিক মান নিয়ন্ত্রণ ও প্যাকেজিং সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। উত্তম চাষাবাদ পদ্ধতি (গ্যাপ) অনুসরণে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করা এবং িএক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনকে রপ্তানি প্রক্রিয়া সমন্বয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। এতে রপ্তানি পণ্যের মান উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হবে।
তালহা জুবাইর মাসরুর: প্রকল্প পরিচালক, টিস্যুকালচার ল্যাব ও হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন প্রকল্প; ডিএই, কৃষি মন্ত্রণালয়
jubair03@gmail.com
- বিষয় :
- সবজি