ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন

কপ২৯ কি ব্যর্থ কূটনীতির নজির?

কপ২৯ কি ব্যর্থ কূটনীতির নজির?

প্রতীকী ছবি

মনজুরুল হান্নান খান

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫০

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে অনুন্নত বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি ধরিত্রীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসেছিল জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯। শুরু হয়েছিল গত ১১ নভেম্বর, শেষ ২৪ নভেম্বর ভোরে। তবে সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সার্বিকভাবে আহত এবং হতাশ করেছে। যদিও কপ২৯ ভেস্তে যেতে যেতে শেষতক যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা মন্দের ভালো। এই কপে তেল কোম্পানিগুলো ১ হাজার ৭০০-এর বেশি লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, যাতে কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়। শেষ পর্যন্ত কপ প্রেসিডেন্ট ওই মন্দের ভালো সমঝোতার সিদ্ধান্ত দেন। 

জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের প্রস্তাবনা হয়েছিল কোপেনহেগেন কপ১৫-তে ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালে প্যারিস কপ২১-এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল– উন্নত বিশ্ব ২০২০-এর মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরবর্তী প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুন্নত বিশ্বকে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষার জন্য দেবে। তারা কথা রাখেনি। যদিও তারা ২০২২ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে বলে দাবি করেছে, এর সপক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য দলিল হাজির করতে পারেনি। 

জলবায়ু অর্থায়নের জন্য গঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটি নতুন ধারণাপত্রে প্রতিবছর ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার জন্য উন্নত বিশ্বের প্রতি প্রস্তাব করে। উন্নত বিশ্ব ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাব করে। সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু দরকষাকষির আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। তখন উন্নত বিশ্ব জলবায়ু অর্থায়নের দাবীকৃত অর্থের মাত্র ২৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এক পর্যায়ে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এ প্রস্তাব মেনে নিতে হয়। 
স্পষ্টত, উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব প্যারিস চুক্তির আওতায় যে অঙ্গীকার করেছিল, তা তারা পূরণের কোনো চেষ্টাই করেনি। 
কপ২৯-এ আরও যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল লস ও ড্যামেজ ফান্ডের কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা। অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো আশা করেছিল কপ২৮-এর প্রথম দিনে প্রতিষ্ঠিত লস ও ড্যামেজ ফান্ড কপ২৯-এ সম্পূর্ণরূপে চালু হয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য দ্রুত অর্থায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। সেই আশায় গুড়েবালি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আশা করেছিল উন্নত বিশ্ব লস ও ড্যামেজ ফান্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ প্রদান নিশ্চিত করবে। এই তহবিলে এ পর্যন্ত উন্নত বিশ্ব ৭২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কপ২৯-এ উন্নত বিশ্ব লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। সেই হিসাবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে মোট অর্থ প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৭২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারই রয়ে গেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর লস অ্যান্ড ড্যামেজ (ক্ষয়ক্ষতি) পূরণের জন্য প্রয়োজন হবে প্রতিবছর ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা ছাড়া লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে প্রতিশ্রুত অর্থ  উন্নত বিশ্ব কবে নাগাদ দেবে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কবে কী পদ্ধতিতে বরাদ্দ করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। 

সত্য, এই তহবিল পরিচালনায় একটি বোর্ড গঠিত হয়েছে– যা তহবিলের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তবে যত দ্রুত এই বোর্ড কাজ করুক না কেন, কোনোভাবেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আগামী দুই বছরের আগে অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ধারণাটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য সুখবর হবে। 
তা ছাড়া লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিশ্বব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক তাদের নিয়মকানুন সহজ করে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড পরিচালনা করবে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংকের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। আরেকটি বিষয় হলো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়টি এখনও উন্নত বিশ্ব সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার প্রমাণ হলো, কপ২৯-এ অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজের ওয়ারস আন্তর্জাতিক ম্যাকানিজমের আওতায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ সম্পর্কে একটি রিভিউ প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তাব করেছিল। এ প্রস্তাব উন্নত বিশ্ব গ্রহণ না করে তাদের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। প্রস্তাবটি এখন হিমাগারে চলে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান না নিলে উন্নত বিশ্ব কখনোই একমত পোষণ করবে না। 
প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম কি চলমান থাকবে? এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিশ্ব কূটনৈতিক কার্যক্রম চলমান রাখা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও কথা উঠেছে। আর্জেন্টিনা জলবায়ু কূটনীতি থেকে তাদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কপ৩০-এ আদৌ তারা যোগদান করবে কিনা, এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। আমাদের একটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। জলবায়ু কূটনীতির জন্য জলবায়ু কনভেনশন ছাড়া আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিদ্যমান নেই। সেই ক্ষেত্রে জলবায়ু কনভেনশনের আওতায় বিদ্যমান কূটনীতিকে কীভাবে আরও জোরদার করা যায় তার পদক্ষেপ নিতে হবে। রাগ কিংবা অভিমান করে জলবায়ু কূটনীতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে জলবায়ু যুদ্ধে পরাজয় মেনে নেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উচিত হবে কপ২৯-এর ব্যর্থতা থেকে নতুন কৌশল গ্রহণ করে ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় কপ৩০-এ নিজেদের সুসংহত করে জলবায়ু কূটনীতিতে বিজয় নিশ্চিত করা। রণে ভঙ্গ দেওয়া কোনো বিকল্প হতে পারে না।

ড. মনজুরুল হান্নান খান: সাবেক অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ সরকার এবং নির্বাহী পরিচালক, ন্যাচার কনভেনশন ম্যানেজমেন্ট 

আরও পড়ুন

×