ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

তৃতীয় মেরু

আমরা কী চাই, ভারত কী চায়!

আমরা কী চাই, ভারত কী চায়!

শেখ রোকন

শেখ রোকন

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫৫ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৫৬

বেশ কয়েক বছর আগে ভারতীয় একজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে বলেছিলাম– ভারতকে বুঝতে হবে, ‘বাংলাদেশ ইজ বাংলাদেশ; নাইদার নেপাল, নর পাকিস্তান’। বাংলাদেশ মানে বাংলাদেশ; এটা নেপালও নয়, পাকিস্তানও নয়। পাকিস্তানের মতোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দেশভাগের ফসল হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো যাবে না। নেপালের মতোই ভৌগোলিকভাবে তিন পাশে ঘিরে থাকা এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য সত্ত্বেও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো যাবে না। 

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, নেপাল ‘বা’ পাকিস্তান নয়, বরং নেপাল ‘ও’ পাকিস্তান উভয়ের মতো করেই বাংলাদেশকে দেখতে চাইছে ভারত। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল; সামাজিক মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল; উভয়ের জাতীয় পতাকা পোড়ানো বা পাড়ানোর মতো অবিমৃষ্যকারিতার পর ২ ডিসেম্বর সেটি আগরতলায় বাংলাদেেশর সহকারী হাইকমিশনের স্থাপনায় হামলায় গিয়ে ঠেকেছিল।

উত্তেজনকার পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফরে এসে বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায় ভারত; ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক সম্পত্তির ওপর আক্রমণের ঘটনাগুলোকে ‘দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়ে তিনি আশা করেন, সম্পর্ক বেগবান করতে বাংলাদেশ ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বিষয়গুলো দেখবে। (সমকাল, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪)।

বাস্তবে দেখা যায়, ডিসেম্বরেই সীমান্ত হত্যাকাণ্ড অন্যান্য মাসের তুলনায় বেড়ে যায়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে যে ৩৮ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হন, তাদের মধ্যে ৭ জনই নিহত হন ডিসেম্বরে। আবার, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরকে ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ আখ্যা দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, ভারতের দিক থেকে পাকিস্তানকে যেমন ‘শত্রুরাষ্ট্র’ বিবেচনা করা হয়ে থাকে, সেভাবেই ভারতীয় সরকার, সংবাদমাধ্যম, নেটিজেনরা মাত্র কয়েক মাস আগেও ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বিবেচিত বাংলাদেশকেও একই তকমা দিতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের এমন যুদ্ধংদেহী অবস্থান কেন? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন নিয়ে ভারতের এমন অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়ার কারণ কী? স্বীকার্য, আওয়ামী লীগের শাসনামলকে খোদ নরেন্দ্র মোদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ আখ্যা দিয়েছিলেন; ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর সেটি কার্যত ‘কৃষ্ণ অধ্যায়’ হয়ে উঠছিল। বাংলাদেশে অতীতেও স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন হয়েছে; ভারত নিয়ে এখনকার চেয়েও বেশি কড়া কথাবার্তা জনপরিসরে এসেছে। তখন তো নয়াদিল্লিকে এখনকার মতো ভূমিকায় দেখা যায়নি!
এটি ঠিক, গত দেড় দশকে নানা উন্নয়ন প্রকল্প ও বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ভারতের অভূতপূর্ব ‘বৈষয়িক স্বার্থ’ গড়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমন কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। শুধু ভিসা বন্ধ হওয়া ছাড়া বাণিজ্য আগের মতোই চলছে। এমনকি যে আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে এত কথা, সেটিও সহসা বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। 

এটিও ঠিক, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুটিতে ভারত আগের চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। অতীতে কংগ্রেস সরকার যদিও এ ধরনের ইস্যুতে যথাসম্ভব শান্ত থাকতে ও রাখতে চেয়েছে; বিজেপি সরকারের অবস্থান সেটি নয়। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে বা বাড়িয়ে কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব? বরং আলোচনা ও পারস্পরিক আস্থাই সবচেয়ে জরুরি। সেটি উভয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সত্য। 

অনেকে মনে করেন, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ‘চীন ফ্যাক্টর’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি তো নতুন নয়; সত্তরের দশক থেকেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ও সামরিক খাতে চীনের প্রভাব রয়েছে। এমনকি খোদ শেখ হাসিনার শাসনামলেও চীনের প্রভাব গভীর হতে হতে সাবমেরিনে গিয়ে পৌঁছেছিল। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদী তিস্তায় চীনের সহযোগিতায় মহাপরিকল্পনাও প্রায় বাস্তবায়িত হয়ে যাচ্ছিল। তখন তো নয়াদিল্লি এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি! বরং ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শেখ হাসিনা যেভাবে ‘ব্যালান্স’ করে চলছিলেন, সেটি সীমান্তের ওপাশে বিভিন্ন সময় প্রশংসিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের অঙ্গীকার অপরিবর্তিত রয়েছে। ভারত যদি সত্যিই ভূ-রাজনীতি ‘মিন’ করত; তাহলে দিল্লিরও এমন অবস্থানই প্রত্যাশিত ছিল।

লক্ষণীয়, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়ে ওই দিনই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভকামনা জানিয়ে এক্সে পোস্ট করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। শুধু তাই নয়, ১৭ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার টেলিফোন আলাপও হয়। এই ফোনালাপ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এক্সে প্রকাশিত এক পোস্টে গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য ভারতের সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তারপর এমন কী ঘটল?

সত্য, শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উষ্মা গোপন রাখেনি। ডিসেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে যদিও তাঁকে ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ; পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে আনা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ঢাকার প্রচেষ্টা সমানতালে চলবে। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে দৃঢ় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে থাকবে (সমকাল, ১ জানুয়ারি ২০২৫)।

প্রভাবশালী ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টও বাংলাদেশকে ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে বলেছে, নতুন বছরে দেশটির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ‘মেরামত’ করা। তার আগে বুঝতে হবে, ভারত আসলে কী চায়? সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বাগাড়ম্বরের বাইরে গিয়ে আন্তরিকভাবে বিষয়টি বুঝতে চেয়েছিলাম ভারতীয় কয়েকজন বিশ্লেষকের কাছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের দেশের এমন অবস্থানের কারণ কী? তারা বলেছেন, ভারতের মূল চিন্তা ‘নিরাপত্তা’ ইস্যু। বিশেষত ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে। গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা সেটিই নিশ্চিত করেছিলেন।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যদি ঢাকা আশ্বস্ত করে যে, তারা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ আমলে নেবে, তাহলে সেটি শক্তিশালী সম্পর্কের ভিত্তি হতে পারে’ (ডেইলি স্টার, ৬ অক্টোবর ২০২৪)। 

কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ কেন ভারতের ‘নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত করতে যাবে? নিজের ভূমি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে ‘নিরাপত্তা’ রপ্তানি করতে গিয়ে পাকিস্তানের কী দশা হয়েছে, সেটি সবাই জানে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ বরাবরই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে জোর দিয়ে এসেছে। বরং ভারত যদি নিরাপত্তা জুজু থেকে বের হয়ে সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বহুলাংশে মেরামত হয়ে যাবে।

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com 

আরও পড়ুন

×