সরকারি চাকরি
যাচাই-বাছাইয়ের নামে খারিজকরণের রাজনীতি
জোবাইদা নাসরীন
জোবাইদা নাসরীন
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:২৪ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৬:৩৯
আমার আব্বা আজ থেকে ৩১ বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা সেই সময়ে সরকারি চাকুরে পিতা-মাতার অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে বড় হয়েছেন। তখন মফস্বল শহরে অনেক পরিবারেই গ্রামের দু’একজন নিকটাত্মীয় থাকতেন, যারা শহরের স্কুল-কলেজে পড়তেন। মফস্বলে তখনও ‘অনেকের অনেক টাকা’– এমন গল্প চাউর হয়েছে কম। এর বিপরীতে ঢাকা শহরে তখনও সচিবদের ‘ডাঁট-ফাট’। সচিবদের টাকা এবং ক্ষমতা থাকবে– এটাই কেন যেন সবাই মনে করত।
এখন সম্পদের দিক থেকে কোনো কোনো সরকারি খাতের অফিস সহকারী বা গাড়িচালকের সঙ্গে সচিবদের তেমন পার্থক্য নেই। বল্গাহীন দুর্নীতি সরকারি চাকরির শীর্ষ পদের সঙ্গে নিম্নতম পদের এ সমতা সৃষ্টি করেছে। তাই বিসিএস তো বটেই; সরকারি চাকরিই এখন খুব লোভনীয়। তবে সব মধু এখন মনে হয় আটকে আছে প্রশাসন ক্যাডারে। চাকরি স্থায়িত্বের পাশাপাশি আছে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, অর্থ, মর্যাদা এবং অদৃশ্য-দৃশ্যমান অনেক কিছু। সবাই সেটি পেতে চায়। রাখতে চায় না কোনো ধরনের কোটার সুবিধা। মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়েই এ দেশে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা।
বহু সাধনার এই সরকারি চাকরি অর্জনে বিসিএস পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। সেটি সম্পন্নকরণে এক থেকে দেড় বছর লাগে। অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছর সময়ও ব্যয় হয়েছে। আর পরীক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রম শেষ হলে সম্মুখবর্তী যে ধাপ, তার নাম ‘ভেরিফিকেশন’। নানা দেশে এই ভেরিফিকেশনের চল আছে; গুরুত্ব আছে রেফারেন্সেরও। কিন্তু বাংলাদেশে এই ‘ভেরিফিকেশন’ যে প্রক্রিয়ায় হয়, সেটি পৃথিবীর অন্য কোথাও বোধ হয় নেই।
প্রার্থী নিজে তা থেকে যত দূরে থাক, তার আত্মীয়স্বজন বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতাদর্শী হলেই এই ‘ভেরিফিকেশন’-এর ফল হয় নেতিবাচক। এগুলো আগে মুখে মুখে শোনা যেত। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরির পর প্রথম জানা গেল আনুষ্ঠানিকভাবে, ২০১০ থেকে সব ধাপে যোগ্যতা অর্জনের পরও বিভিন্ন বিসিএসে বাদ পড়ে ২৫৯ জন। এই ‘বাদ’ পড়ার কারণ প্রার্থী কিংবা প্রার্থীর পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের তৎকালীন সরকারের রাজনীতির অনুসারী না হওয়া। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই বাদ পড়াদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে; কিন্তু ‘ভেরিফিকেশন’ প্রক্রিয়ার ত্রুটি সংশোধন করেনি।
কেন করেনি– এর উত্তর জানার জন্য আমাদের ৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেখানে একই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে প্রথমে ২৬৭ জনকে। পরে শোরগোল হলে সংশোধন করে ১৬৮-তে নামিয়ে আনা হয়। কী এই বাদ দেওয়ার রাজনীতি?
খারিজ করা বা বাদ দেওয়ার মানসিকতা এ দেশে বহুল প্রচলিত একটি বিষয়। আমার দলের না হলে বাদ; ধর্মীয় মিল না থাকলে বাদ; একই জাতির না হলে বাদ কিংবা একই মতাদর্শের হলেও আমার কথাতে ১০০ শতাংশ সমর্থন না করলে বাদ। এই বাদের রাজনীতির শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হলো তকমা প্রদানের রাজনীতি। আগে ভয়াবহ অস্ত্র ছিল ‘জামায়াত, বিএনপি, বামাতি’। এখন হলো ‘আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিস্টের দোসর’ কিংবা ঠিক ‘আমাদের মতো বিপ্লবী’ কিংবা ‘বুঝদার’ নয়। অথচ তকমাবাদী রাজনীতি মূলত বৈষম্যবাদকেই জিইয়ে রাখে।
উল্লিখিত ১৬৮ জনকে বাদ দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে অনেকটা গলা পরিষ্কার করেই বলা হয়েছে– “সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে ‘ক্লিন ইমেজ’-এর প্রার্থী নির্ধারণে এবং সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে ৪৩তম বিসিএসের সুপারিশকৃত ২ হাজার ১৬৩ জন প্রার্থীর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা এনএসআই এবং ডিজিএফআইর মাধ্যমে প্রাক চরিত্র পুনরায় অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।” একই পত্রে আরও রয়েছে, ‘প্রতিবেদন অনুযায়ী ২২৭ (দুই শত সাতাশ জন) প্রার্থীর প্রাক চরিত্র বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য (আপত্তি/ অসুপারিশকৃত) পাওয়া যায়। ২২৭ প্রার্থীর বিষয়ে বিরূপ মন্তব্যের কারণে সাময়িকভাবে নিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত মনে করা হয়। এবং তাদের বিষয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই ও খোঁজখবর নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (পত্র স্মারক নং-০৫-০০-০০০০.১৪৭.১১. ০০৩.২৪.০৪)।’ পত্রে বিসিএস নিয়োগ রুলস ১৯৮১-এর ৪ ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই ধারায় পুলিশের বিশেষ শাখা এবং জেলা প্রশাসকদের এই দায়িত্ব পালন করার কথা। কোনোভাবেই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পুলিশের বিশেষ শাখা নয়। তাহলে তাদের কীভাবে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হলো? কেন করা হলো? মূলত কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকলে কিংবা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাকে বাদ দেওয়া যাবে। মামলার বিষয়টি পুলিশের খাতায়ই থাকে। তাই বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহের বিষয় নেই। কিন্তু বর্তমান প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে আছে ভিন্নমতের প্রার্থীদের চিহ্নিত করা; তাদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা।
এই প্রক্রিয়ায় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে যুক্ত করার মানে হলো, তাদেরকে যখন যে সরকারে থাকে, তাদের হয়েই কাজ করতে বাধ্য করা। এই যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ‘ক্লিন ইমেজ’ প্রার্থী চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হলো, সেটার পদ্ধতিই বা কী?
বিসিএস একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা। এর সবকিছুর জানার অধিকার সবার আছে। বাদ দেওয়ার রাজনীতি যেমন আগের সরকারগুলো করেছে, এখনও সেটিরই পুনরুৎপাদন হচ্ছে। একই প্রশ্নবোধক প্রক্রিয়ায় ৪০তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া ২৫ জন সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) মধ্যে অন্তত ২১ জনকে চাকরি থেকেই বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে বিবিসি বাংলা ৫ জানুয়ারি জানিয়েছে।
সংস্কারে অঙ্গীকারবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের ‘খারিজকরণ’ মানসিকতা ধরা পড়ে গত অক্টোবর মাসেই। সেই মাসেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রাজশাহীর চারঘাটে সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই অব্যাহতির কারণ হিসেবে ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’ করার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু এ শৃঙ্খলা ভঙ্গের রূপটা কেউ জানে না। আর সেই ‘বাদ’ দেওয়া তালিকাতে যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো হয়, তখন সরকারের আরও ভয়াবহ এক মানসিকতা ধরা পড়ে। যেন এ দেশে ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’ সংখ্যালঘুই বেশি করে। কথিত ‘ক্লিন ইমেজ’ রক্ষায়ও তারা ব্যর্থ!
‘কই, আগে তো এগুলো নিয়ে কথা বলেননি’? কিংবা ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’– এই জাতীয় প্রশ্ন ছুড়ে কারও বৈষম্যের তরিকাকে বৈধ করা যায় না। কারণ সেগুলো ঘটেছিল বলেই তো বিগত সরকারকে জনগণ বিতাড়িত করেছে। সংস্কারের মূল লক্ষ্যই তো হওয়ার কথা বৈষম্য রোধ। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর কৌশল থেকে দূরে থাকলেই বিগত পূর্বসূরির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পার্থক্য স্পষ্ট হতো। যাচাই-বাছাইয়ের নামে ‘খারিজকরণ’-এর রাজনীতি টিকিয়ে রেখে এ সরকার প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: zobaidanasreen@gmail.com
- বিষয় :
- সরকারি চাকরি