অন্যদৃষ্টি
লালফিতায় বাঁধা শহীদের নাম!
প্রতীকী ছবি
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৫১
বিশ্বের যেসব দেশ প্রশাসনিক জটিলতায় ‘সুনাম’ কুড়িয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয়। পরাধীন ভারতবর্ষে মূলত সাধারণ মানুষকে হয়রানির লক্ষ্যে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সূত্রপাত হয়েছিল, তা এখনও দিব্যি চলছে! ক্রমবর্ধমান হারে যুক্ত হয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা।
কিন্তু জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদের তালিকায় নাম ওঠাতে গিয়েও তাদের পরিবারের হয়রানির খবর যখন পড়তে হয়, তখন বেদনা ও বিক্ষোভ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মঙ্গলবার সমকালের এক প্রতিবেদনমতে, গণঅভ্যুত্থানে ৮২৬ শহীদের তালিকায় সিলেটের ১২ জনের নাম যুক্ত করা হলেও বাকি ৪ জনের পরিবার হয়রানির শিকার হচ্ছে।
সোমবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাদ পড়া শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করা যাবে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফাঁদ যদি সরানো না যায়, কাজটি কত জানুয়ারিতে সম্পন্ন হবে আমরা জানি না। উপরন্তু শহীদদের পরিবার ইতোমধ্যে যে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তা বর্তমান সরকারের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
আমরা জানি, গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব শহীদদের যথাযথ স্বীকৃতি। বলা চলে, এটি গণঅভ্যুত্থানের সার্থকতার প্রথম সোপান। প্রথম সোপানের প্রথম কাজটি বা শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্তিই যখন লালফিতার দৌরাত্ম্যে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন সরকারের পরবর্তী কাজগুলোর ব্যাপারেও সংশয় স্বাভাবিক।
তৎকালীন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ৩ আগস্ট ২০২৪ শহীদ মিনারে যে এক দফা ঘোষণায় স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের ডাক দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সরকারি কাজে লালফিতার উৎপীড়ন। গণঅভ্যুত্থানের পরও যদি সেই উৎপীড়ন অব্যাহত থাকে, তাহলে এত মানুষ প্রাণ দিল কেন? গণঅভ্যুত্থানের মূল স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে হলে বিশেষত সরকারি দপ্তরের লালফিতার দৌরাত্ম্য বিলীন অত্যাবশ্যক।
স্বাধীনতার পর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়েও আমরা বিচিত্র ‘রাজনীতি’ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধকালে যাদের জন্ম হয়নি, এমন ব্যক্তিরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পাওয়ার নজির রয়েছে। তালিকায় নাম ওঠাতেও লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন রাজনীতিবিদরা জড়িত, তেমনি আমলাতন্ত্রও। খোদ আমলাদের কেউ কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে পরে ধরা পড়েছেন।
আমাদের প্রত্যাশা, গণঅভ্যুত্থানের তালিকা নিয়ে এ ধরনের ‘ব্যবসা’ হবে না। সে আশঙ্কা দূর করতে হলে প্রথমেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার জরুরি। বিশেষত দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনিক যে স্থবিরতা তৈরি করা হয়েছে, সেটির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অন্যথায় পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিলোপ করা সম্ভব হবে না।
গত পাঁচ মাসেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে পারেনি। তা ছাড়া সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ইংরেজি সংবাদপত্র নিউ এজ সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা ও সহায়তা প্রদানে অসংগতির কথা স্বীকার করেছেন। এর কোনোটাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।
তবুও আমাদের প্রত্যাশা, সরকারের প্রশাসনিক কাজে আরও গতি আসবে। বিশেষত আন্দোলনে আহতদের ব্যাপারে তারা আরও দায়িত্বশীল হবেন। সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব শহীদের নাম এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মতো গণঅভ্যুত্থানের শহীদের তালিকা যাতে কালিমালিপ্ত না হয়, সে ব্যাপারেও তারা সচেতন থাকবেন।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.com
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি