মেটার সিদ্ধান্ত
ফ্যাক্টচেকহীন ফেসবুক: সামাজিক মাধ্যমে সিঁদুরে মেঘ!
রফিকুল রঞ্জু
রফিকুল রঞ্জু
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৪১
মহাকায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটা ধাক্কা খাওয়ার মতো ঘোষণা দিয়েছে– ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও থ্রেডসে ফ্যাক্টচেক বাতিল করে ‘রাজনৈতিক কনটেন্ট’ বাড়ানো হবে। যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে এ ঘোষণার কার্যকারিতা শুরু। ধীরে ধীরে সারাবিশ্বেই এটি হবে।
মেটা-প্রধান মার্ক জাকারবার্গ মুক্তমত বা বাকস্বাধীনতায় অগ্রাধিকারের যুক্তি দেখিয়ে নতুন এ নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন। ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে মেটা মুক্তমতকে অগ্রাধিকার দিতে চায়।
জাকারবার্গ ২০১৬ সালে চালু ফ্যাক্টচেকিং ব্যবস্থাকে এখন বাকস্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন। তাঁর ভাষায়, মেটার ফ্যাক্টচেকারদের রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে আস্থা ধ্বংস হয়েছে এবং তাদের কাজ প্রত্যাশিত ফল আনেনি।
যদিও শুরু থেকেই ফ্যাক্টচেকিংকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে; হঠাৎ কী এমন ঘটনায় পুরো বিষয়ই নেতিবাচক হয়ে গেল? এরই মধ্যে কথা উঠেছে, মেটার নীতিগত পরিবর্তন নয়, প্রকৃতপক্ষে এটি রাজনীতিগত পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুষ্ট করতেই এ পরিবর্তন। মেটার সিদ্ধান্তকে ট্রাম্পের সমর্থকরা এরই মধ্যে স্বাগত জানিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে ডানপন্থিদের অভিযোগ, ফ্যাক্টচেকারদের কারণে তাদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; তাদের বাকস্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি এবং তাদের বিলিয়নেয়ার মিত্র ইলন মাস্কও এমনটি মনে করেন। এ জন্য মাস্ক তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যমে ডানপন্থিদের সুবিধা দিতে এক্সে (সাবেক টুইটার)
ফ্যাক্টচেকারদের রাখেননি। তার বদলে ‘কমিউনিটি নোটস’ রেখেছেন। জাকারবার্গও একই পথে হাঁটছেন। ফেসবুকে তিনিও কমিউনিটি নোটস চালু করেছেন।
মেটার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আসলে সামাজিক মাধ্যম বিপদের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে যাচ্ছে। অপতথ্য, ভুল তথ্য, গুজবের দুয়ার খুলতে যাচ্ছে। মিথ্যা বয়ানের রমরমা তৈরি হতে যাচ্ছে। এগুলো এখন আগের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বে অপতথ্য ও ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়ানোর ঝুঁকি যখন ক্রমাগত বাড়ছে; মুক্তমতকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি যখন ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে; তখন এ ধরনের পদক্ষেপ বাড়তি বিপদের শঙ্কা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে ঝুঁকি আরও বেশি। এখানে এমনিতেই হাতেগোনা কিছু ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য, ভুল তথ্য, গুজব ধরতে হাঁপিয়ে উঠছে। ফ্যাক্টচেক বাদ পড়লে পরিস্থিতি কতটা নাজুক হবে, তা অকল্পনীয়। প্রশ্ন হতে পারে, মেটা বা ফেসবুক ফ্যাক্টচেক বাদ দিলেও ফ্যাক্টচেকারদের কাজ চালাতে সমস্যা কোথায়?
প্রথমত, এখন ফ্যাক্টচেকাররা কোনো অপতথ্য, ভুল তথ্য বা গুজব চিহ্নিত করলে কনটেন্টকে ফেসবুকে লেবেল দিয়ে দেয় বা ফ্ল্যাগ ওঠায়। ফেসবুকের অ্যালগরিদম কনটেন্টটি আর ছড়াতে দেয় না। কেউ শেয়ার করতে গেলেও দেখায় কী কারণে কনটেন্টটি ক্ষতিকর। ফ্যাক্টচেকিং উঠে গেলে সেই ‘চেক অ্যন্ড ব্যালান্স’ থাকবে না। পাশাপাশি নতুন ব্যবস্থায় যেহেতু ব্যবহারকারীর পছন্দের কনটেন্ট বেশি বেশি দেখানোর নীতি নেওয়া হয়েছে, সেহেতু ক্ষতিকর কনটেন্টের প্লাবন নামতে পারে। দ্বিতীয়ত, ফ্যাক্টচেকিং একটি সুসংঘবদ্ধ, প্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা; আর্থিক বিষয়াদিও এতে যুক্ত। ফ্যাক্টচেংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজের জন্য মেটা থেকে সে ধরনের সহায়তাও পেত। সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকবে এবং পেশাদারির সঙ্গে ফ্যাক্টচেকিং পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে।
সে ক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলো ফ্যাক্টচেকিংকে গুরুত্ব দিতে পারে না? তা পারে। কিন্তু সেটি হলেও তা হবে সামাজিক মাধ্যমের বাইরে। তা ছাড়া তত্ত্বগতভাবে ধরলে সংবাদমাধ্যম তো ফ্যাক্টেরই মাধ্যম। তাহলে আলাদা করে ফ্যাক্টচেকার তাদের লাগবে কেন?
অবশ্য মেটার সিদ্ধান্ত সংবাদমাধ্যমের জন্য কিছুটা হলেও আশীর্বাদ। কারণ সামাজিক মাধ্যমের তথ্য যাচাই করতে মানুষ হয়তো সংবাদমাধ্যমের দিকে ঝুঁকবে। যদিও সংবাদমাধ্যমের তথ্য নিয়েও নানা বিতর্ক আছে। আমাদের দেশে তা আরেকটু বেশিই। কারণ, এ দেশে সংবাদমাধ্যমে ফ্যাক্ট ও বস্তুনিষ্ঠতায় বড় ধরনের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। তাই দায়িত্ব চাপে পাঠক ও ব্যবহারকারীর ওপরেই। সন্দেহ নেই, মেটার নতুন সিদ্ধান্তে সেই চাপ আরও বাড়বে।
অন্য একটি প্রশ্নও থেকে যায়, ফ্যাক্টচেকিং কি সত্যিই মুক্তমত বা বাকস্বাধীনতায় বাধা? যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান পলিটিফ্যাক্টের নির্বাহী পরিচালক অ্যারন শারোকম্যানের মতে, ফ্যাক্টচেকিং বাকস্বাধীনতায় বাধা নয়। ফ্যাক্টচেকাররা যে পোস্টে অপতথ্য দেখতে পান, সেখানে বাড়তি তথ্য ও পরিপ্রেক্ষিত যুক্ত করেন। সেখানে মানুষের ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগও থাকে। বলা বাহুল্য, ফ্যাক্ট বা প্রকৃত ঘটনাই সব ধরনের আলাপ, সংবাদ বা তথ্যের ভিত্তি হওয়া উচিত। তাই কোনো ভুল বা অপতথ্যের বিপরীতে সঠিক তথ্য উপস্থাপন কখনও বাকস্বাধীনতায় বাধা হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
সবচেয়ে বড় কথা, সামাজিক মাধ্যমও এক প্রকার সংবাদমাধ্যম। এখানে শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ হয় না; বড় অডিয়েন্স বা দর্শক-শ্রোতার সামনে তথ্য/মত/বয়ান হাজির করা হয় প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের মতোই। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব পড়ে। পাঠক ও দর্শক হিসেবে আমরা সংবাদমাধ্যমের কাছে সঠিক তথ্য বা ফ্যাক্ট আশা করি; বস্তুনিষ্ঠতা আশা করি। তাহলে সামাজিক মাধ্যমে কেন সঠিক তথ্য, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য আশা করব না? সংবাদমাধ্যমের ভুল বা অপতথ্য যেভাবে, ঠিক সেভাবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য, গুজবও ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শেষ প্রসঙ্গ, কমিউনিটি নোটস। বলা হচ্ছে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মেটা ব্যবহারকারীরা নিজেরা ভুল তথ্য, অপতথ্য সংযুক্ত পোস্ট চিহ্নিত করতে পারবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পোস্টে প্রাসঙ্গিক তথ্য যোগ করতে পারবে। দৃশ্যত বিষয়টি নিরীহ মনে হতে পারে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আরও বড় ধরনের বিপর্যয় আনতে পারে। ফ্যাক্টচেকিংয়ের মাধ্যমে সঠিক তথ্য উপস্থাপনের মধ্যেই মেটা যেখানে পক্ষপাত, ফ্যাক্টচেকারদের আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয় দেখতে পাচ্ছে; সেখানে বিষয়টি কমিউনিটির ওপর ছাড়তে চায় কোন ভরসায়?
খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাব, বাংলাদেশেও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ‘বটবাহিনী’ বলা হচ্ছে। তারা নিয়োগকারী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় যাচ্ছেতাই কর্মকাণ্ড করে। বিভ্রান্তিকর, মানহানিকর, আক্রমণাত্মক কনটেন্ট ও মন্তব্য পোস্ট করছে তারা। বিপক্ষের আইডির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে অভিযোগ করে সেটি কখনও বন্ধ, কখনও রেস্ট্রিকশনে ফেলছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কমিউনিটি নোটস ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ সংঘবদ্ধ সেসব গোষ্ঠী বা বটবাহিনীর হাতেই চলে যেতে পারে। এমনকি সঠিক তথ্য এবং তা উপস্থাপনকারীকে হেনস্তার আশঙ্কাও রয়েছে।
রফিকুল রঞ্জু: অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- ফেসবুক