ঢাকা রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

সাদাকালো

রুপা হকের মন্তব্য এবং রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

রুপা হকের মন্তব্য এবং রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

সাইফুর রহমান তপন

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৪৬

বাংলাদেশের রাজনীতি দুই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা– প্রশ্নটি নতুন করে তুলেছেন ঢাকা সফররত ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদ সদস্য রুপা হক। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘একজন নেতার কন্যা, আরেকজন নেতার বেগম এবং তাদের ছেলেরা সব কিছুতে আধিপত্য দেখাবে–  এ প্রবণতার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রায় ৫৪ বছরের এ বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসতে একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান দরকার’ (সমকাল, ৮ জানুয়ারি ২০২৪)। 

দুই পরিবার বলতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকারীদের বোঝানো হয়। এ দুই পরিবারের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চার দশকেরও বেশি সময় দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। 

রাজনীতিতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রশ্ন ওঠে নব্বই দশকের মাঝামাঝি। তা আরও জোরালো হয় পরের দশকের মাঝামাঝি, যখন দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই এসেছিল ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার। রাজনীতি থেকে দুই পরিবারকে বিদায়ে তখনকার উদ্যোগ ‘মাইনাস টু থিওরি’ নামে পরিচিতি পায়।

রুপা হকের বক্তব্যের আগে রাজনীতিতে দুই পরিবারের প্রভাব হ্রাসের কথা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারাও বলেছেন। সম্ভবত এ কারণেই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান অংশীজন বিএনপির কোনো কোনো নেতা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্মেও ‘মাইনাস টু’ ছায়া দেখতে পান। আমার ধারণা, প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপির মুখে একই কথা শুনে মাইনাস টু ভীতি আরও ছড়াবে। 

লক্ষণীয়, রুপা হক এমন সময়ে কথাটা বললেন, যখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলেন। তাঁর এই লন্ডনযাত্রার অনুমতির জন্য বিগত সরকারের সময় বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করেছে। তাই ৫ আগস্টের পর ধারণা করা হচ্ছিল, অচিরেই তিনি বিদেশে যাবেন। কিন্তু তাতে যত বিলম্ব ঘটছিল, ততই এ ধারণা দানা বাঁধছিল– এর সঙ্গে ‘মাইনাস টু’ নিয়ে বিএনপির সন্দেহের সম্পর্ক থাকতে পারে। 

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও রুপা হক ব্রিটিশ নাগরিক। তাই হয়তো মন্তব্যকে নিছক অনধিকার চর্চা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘ওয়ান ইলেভেন’ সংঘটিত হওয়ার আগে-পরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর তৎপরতাও অনেকের মনে পড়বে। অবশ্য রুপা হকের পরামর্শের সঙ্গে আনোয়ার চৌধুরীর তৎপরতার সম্পর্ক নিছক কাকতাল হতে পারে। তবে এমন পরামর্শ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ কতটা প্রস্তুত, খতিয়ে দেখা যেতে পারে। স্বীকার্য, স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব সরকারের আমলেই যেভাবে আত্মীয়তন্ত্র ও স্বজনতোষণ জেঁকে বসেছে; শাসক দলে পরিবারতন্ত্রের আধিপত্যই তার মূল কারণ। উপরন্তু, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে তৃণমূলেও একই প্রবণতা ও প্রাধান্য ক্রমেই প্রকট হয়েছে। বিশেষত এমপি ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পদেও পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রথাই কায়েম হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় এক প্রকার জমিদারতন্ত্রের কারণে শুধু দুর্নীতি-অনিয়মই গেড়ে বসেনি; স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশও প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এর পরও বলা যাবে না, দল দুটির শীর্ষ পদে দুই পরিবারের কোনো সদস্যকে সাধারণ নেতাকর্মী চায় না। আর যে কোনো রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করার নিয়ামক শক্তি কেবল নেতাকর্মীই।

এটাও মনে রাখতে হবে, মূলধারার রাজনীতিতে নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের কর্তৃত্ব দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই বিদ্যমান। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়াও ব্যতিক্রম নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ ধারার প্রায় সব দেশেই রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র এসেছে দেশগুলোর প্রতিষ্ঠাকালে বা গভীর কোনো রাজনৈতিক সংকটকালে সংশ্লিষ্ট পরিবারপ্রধানের জনঘনিষ্ঠ ভূমিকার বদৌলতে। এটাও সত্য, দেশগুলোতে যে কোনো কারণেই হোক; বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি দাঁড়াতে পারেনি বিধায় নির্দিষ্ট পরিবারগুলোরই ওপর জনমানুষ ভরসা রেখে চলেছে।

বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন অখণ্ড পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের নির্দেশনা মেনে অন্য অনেক দলের নেতার মতো আওয়ামী লীগ নেতারাও দলকে পুনরুজ্জীবিত না করার অঙ্গীকার করেছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস সাক্ষী– ১৯৬২ সালে একদিকে আইয়ুব খানের রক্তচক্ষু, আরেকদিকে দলের তৎকালীন প্রবীণ নেতাদের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ে তিনি দলটি পুনর্গঠিত করেন। এ দল নিয়েই তিনি ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে জনতাকে নিয়ে যান। ফলে জনতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়।

জিয়াউর রহমানও এমন সময়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, যখন আওয়ামী লীগের বাইরে শক্তিধর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। চুম্বকের যেমন দুই মেরু থাকে, তেমনি রাজনীতিতেও পরস্পরের প্রতিপক্ষ দুটি দল জরুরি– গণতন্ত্রেরই স্বার্থে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে  আওয়ামী লীগই শুধু বিপর্যস্ত হয়নি, তার প্রধান প্রতিপক্ষ জাসদও ভীষণ দুর্বল হয়ে যায়। তবে আওয়ামী লীগ তার অন্তর্নিহিত শক্তির কারণে পুনরায় দাঁড়াতে পারলেও অন্য দলগুলোর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। এ শূন্যতা পূরণ করে বিএনপি।

আবার, ১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগকে এমনই নেতৃত্বশূন্যতায় ফেলে, যা ভরাট করতে তৎকালীন দলের সিনিয়র নেতারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান পদে বসান। অন্যদিকে, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্যই কেবল খালেদা জিয়াকে বিএনপি চেয়ারপারসন বানানো হয়। উভয় নেতাই জীবিত থাকলে তাদের উত্তরাধিকারীরা রাজনীতিতে আসতেন কিনা, নিশ্চিত করে বলা যায় না। 

মোদ্দা কথা, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আধিপত্য যেমন ওপর থেকে আরোপিত নয়, তেমনি দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বও উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। তবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দল দুটিতে পারিবারিক আধিপত্য কতটুকু ধরে রাখতে পারবে– সে প্রশ্ন তোলাই যায়। এই সুযোগে দল দুটির অভ্যন্তরে জনসম্পৃক্ত কোনো বিকল্প নেতৃত্ব যদি উদ্ভূত হয়, কিংবা উন্নততর আদর্শ ও নীতি নিয়ে বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দল দাঁড়ায়, তাহলে নিরাকরণ প্রক্রিয়াতেই হয়তো মূলধারার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব কমতে পারে।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×