প্রতিবেশী
মিয়ানমার জান্তার শেষের শুরু
ফাইল ছবি
ডেভিড স্কট ম্যাথিয়েসন
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:০৩
২০২৪ সালের শেষদিকে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন মিয়ানমারের প্রতিরোধ ও তাঁর সমর্থকদের আরও উৎসাহিত করেছে। মিন অং হ্লাইংয়ের শাসনেরও কি একইভাবে দ্রুত পতন ঘটতে পারে? সে পতন দেখতে কেমন হবে? মিয়ানমারের ক্ষেত্রের এই ‘পতন’ বলতে কী বোঝায়, তা পরিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে কি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পরিষদের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? যদি সামরিক বাহিনী বহাল থাকে, তাহলে জান্তা বাহিনীর একেকটি দলের পতনের মধ্য দিয়ে অন্যটির পরিণতি নিয়ে আসবে। পর্যবেক্ষকরা কিছু সময়ের জন্য অনুমান করেছেন, সম্ভবত মানসিক ভারসাম্যহীন উপপ্রধানমন্ত্রী সো উইনের অধীনে শাসনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিস্থাপন আরও বেশি নির্মম হতে পারে।
সিরিয়ার সঙ্গে যে কোনো তুলনা শুধু এক অর্থে প্রযোজ্য। যেমন আসাদের পলায়নে যেসব প্রধান কারণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়, সেগুলো মিয়ানমারের ক্ষেত্রে খাটে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকের ভূ-কৌশলগত কারণগুলো বেশ আলাদা। সংঘাতের গতিশীলতা মৌলিকভাবে ভিন্ন। একইভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর জেনারেলদের দৃষ্টি অস্পষ্ট এবং আসাদের দ্রুত ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কারণে তারা অস্বস্তিতে পড়তে পারেন।
মিয়ানমারের অনেক রাজনৈতিক নেতা অতিশয় আশাবাদী এবং যে কোনো ধরনের বিজয়ের পর শাসন ও সহযোগিতার বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলো কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে সমালোচিত হয়েছেন। পণ্ডিত নি নি কউ সম্প্রতি বসন্ত বিপ্লবে তাঁর লেখায় ‘নেতৃত্বের ঘাটতি’ সম্পর্কে জোর দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো বিজয়ের পরদিন এই অভাব পূরণ হবে না। প্রকৃতপক্ষে এটি আরও বাড়তে পারে। কারণ, মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) কর্মকর্তারা পদের জন্য ধাক্কাধাক্কি করে; আর কারা দেশের অভ্যন্তরে ছিল এবং কারা পশ্চিমে বসবাস করেছিল তা নিয়ে অনিবার্য বিতর্কের তিক্ততা অভিজাতদের আরও বিভক্ত করতে পারে। অন্য কথায়, এখানে মূল প্রশ্নটি হওয়া উচিত, জান্তার দ্রুত পতন ঘটলে এনইউজি ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনী কি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুত?
মিয়ানমার শাসনের পতনের পর দলের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা খুবই বাস্তব। মিয়ানমারে আন্তঃগোষ্ঠী সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব নৃগোষ্ঠীগত সংগঠ (ইএও) কাজ করে তারা মূলত ভ্রাতৃহত্যা হটিয়ে দিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উত্তর শান রাজ্যের মতো জটিল যুদ্ধক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য। কিন্তু চিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অনেক বিপ্লবী দলের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাগাইংয়ের বেশির ভাগ সহিংসতা ‘বিপ্লবী গ্রাম’ ও জান্তাপন্থি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘটছে। এটি এমন এক চক্র যা পারস্পরিক সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিশোধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। জান্তার পতন হলে পরিচয়, সম্পদ, চেক পয়েন্ট ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতার নিরসন হবে না। জান্তার পতনের পরদিন মিয়ানমার একটি ‘বার্মা স্বর্গরাজ্য’ হবে– এমন ধারণা বিপজ্জনকভাবে কাল্পনিক। অস্বচ্ছ সামরিক অভিজাতদের মধ্যে সবসময় একটি ‘মধ্যপন্থি’ জেনারেলের সন্ধান করার প্রবণতা রয়েছে। কাউকে যুদ্ধাপরাধে কম যুক্ত বলার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী মাত্রই যুদ্ধাপরাধী। মধ্যপন্থি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যে কোনো আন্দোলন কিংবা তৃণমূলে পদাতিক সৈন্যদের মধ্যে যারা সংঘাতের অবসান চায়, আপাতত দু’দলই কল্পনার রাজ্যে বাস করছেন।
চার বছরের ধ্বংসাত্মক সংঘাতে ইতোমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়া অনেক সম্প্রদায় হয়তো কিছুটা নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু অন্যরা সমানভাবে প্রতিশোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে এবং সামরিক বাহিনীর সম্পূর্ণ নির্মূলের চেষ্টা করতে পারে। শাসন পতনের প্রক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে অসংখ্য ভিন্নমত রয়েছে। সামরিক বাহিনীর মূলোৎপাটন করতে আরও সহিংসতার দরকার হবে? নাকি সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া মেনে চলা হবে? কিন্তু কারা সে কাজ করবে? এনইউজি? নাকি ইএও জোট? চলমান পরিস্থিতিতে ও ভবিষ্যতে আরও বড় সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ দুঃখজনকভাবে তা নিয়ে চিন্তা করার অভাব দেখা যাচ্ছে।
আসন্ন পতনের ব্যাপারে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৫ সালে জান্তার পরাজয় বা পতন সম্পর্কে যে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী তাই সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত। সব ধরনের দ্বন্দ্বের মতো সুযোগ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। যদি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল (এসএসি) দ্রুত কিংবা ধীরে ধীরে ধসে পড়ে, তাহলে এটি হয়তো প্রায় সবার কাছে বিস্ময়কর মনে হবে। সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো সম্ভাব্য পরিস্থিতি মাথায় রেখে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা, কিন্তু তা অতি উগ্রবাদের পরিবর্তে বাস্তবতার ওপর দৃঢ়ভাবে পোক্ত হতে হবে।
ডেভিড স্কট ম্যাথিয়েসন: বিশ্লেষক ও মিয়ানমার গবেষক; ইরাবতী
থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
- বিষয় :
- প্রতিবেশী