‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’ কতদূর?
এহ্সান মাহমুদ
এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:০৪
রাজনৈতিক সভা শেষে এক নেতা গলায় কিছু ফুলের মালা নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন; মুখ গম্ভীর। পাশেই দাঁড়ানো আরেকজন বললেন, ‘ভাই, ঘটনা কী! গলায় এত মালা, কিন্তু আপনার মুড অফ ক্যান?’ নেতা অবিশ্বাস ও বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘পয়সা দিলাম দুইশ ফুলের মালার। অথচ আমার গলায় দিছে পঞ্চাশটা!’
এ ধরনের আরও কিছু রাজনৈতিক কৌতুক আমরা উপভোগ করতে পারতাম, কিন্তু দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় এতটা হেঁয়ালিপনা উচিত হবে না। বরং এই কৌতুকের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রাজনৈতিক দৃশ্যের দিকে ফিরে তাকাই।
বিদায়ী বছরে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বিজয় র্যালির আয়োজন করেছিল ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। বাংলামটর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে বেশ বড়সড় মিছিল। ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারের বাইরে নতুন পরিচয়ে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। আত্মপ্রকাশের পর ছোট আকারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলেও বিজয় দিবসের সেই র্যালির মতো ‘শোডাউন’ দেখা যায়নি। বিজয় র্যালিতে ঢাকার বেশ কয়েকটি থানা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও সংগঠনের ব্যানার নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কেউ কেউ।
জাতীয় নাগরিক কমিটির বিজয় দিবসের এই কর্মসূচি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলতে হবে। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর থেকেই এ আন্দোলনের সামনের সারির নেতারা নতুন যে রাজনৈতিক দলের কথা বলে আসছিলেন, তার প্রস্তুতি চলছে নাগরিক কমিটির অধীনে, যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও ভূমিকা রাখছে। নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন– আলাদা নাম হলেও মূলত একই বৃন্তে দুটি ফুল। তাত্ত্বিক অবস্থানের বাইরে ভৌত অবস্থানগত দিক থেকেও পরস্পরের নৈকট্য স্পষ্ট– রাজধানীর বাংলামটরে একই ছাদের নিচে তাদের দপ্তর।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই আন্দোলনের চেতনার ধারক হিসেবে এখন ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’ অপরিহার্য। তবে রাজনৈতিক শক্তিটি কখন হবে, কীভাবে হবে, কাদের নেতৃত্বে, সেটি দেখার বিষয়। ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে যারা আসতে চাইছে, তাদের সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর পার্থক্যই বা কতটুকু? নতুন রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও ইশতেহারে এমন কী নতুন বিষয়, নতুন স্বপ্ন থাকবে, যা পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে নেই? রাজনীতির পুরোনো দোকানে নতুন বিক্রয় প্রতিনিধি হাজির করাই কি নতুন দিনের রাজনীতি?
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে তীব্র লড়াই ও প্রতিরোধের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করলেন, এটাকে এখন নানা অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করা গেলে অনেক পক্ষের অনেক ফায়দা। সেই ফায়দার অংশ হিসেবেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নতুন রাজনৈতিক দল? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন– সংস্কার, নাকি নির্বাচন আগে। বিতর্কটি কি ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’র নিরাপদ উত্থান নিশ্চিত করার বাহানা? নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দল না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজন বিলম্বিত হতে পারে বলেও কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাই নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের উচিত নিজেদের অবস্থান জনগণের সামনে স্পষ্ট করা। আড়ালের শক্তির দিকে না তাকিয়ে জনগণের চোখে চোখ রাখা।
যদিও বলা হচ্ছে, নতুন দলের নেতৃত্বে থাকবেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ছাত্র সংগঠনের নেতারা; এতে মাঝারি রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমসূত্রে পরিচিতি পাওয়া ব্যক্তিদের যুক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রচার ও জনসংযোগ চালিয়ে সমর্থন বৃদ্ধির চেষ্টাও চলছে।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলছেন, সংগঠন দুটি অরাজনৈতিক থাকবে। বিভিন্ন পর্যায়ের সমন্বয়ক-সদস্য সংগঠন দুটির সঙ্গে যুক্ত থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করার পরও মূল সংগঠনগুলো থেকে যাবে ‘অরাজনৈতিক’! এমন দ্বিভাবযুক্ত অবস্থান শেষ পর্যন্ত দেশবাসীকে কী বার্তা দেবে– সেটা নিয়েও সমন্বয়ক বা নেতাদের ভাবতে হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মতে, নতুন দল চাঁদাবাজি ও ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। যদিও সম্প্রতি সংগঠনটির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আসার পর চারজনকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাবকে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো স্বাগত জানালেও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় দল গঠন বিষয়ে সতর্ক করেছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নতুন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে প্রয়োজনে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটবে। এটি গণতান্ত্রিক রীতি। তাঁর মতে, ‘জনগণ কোন রাজনৈতিক দলকে গ্রহণ করবে কিংবা বর্জন করবে, নির্বাচনের মাধ্যমে সেই রায় দেবে। তবে যারা জনগণের আদালতের রায়ের মুখোমুখি হতে ভয় পায় কিংবা যাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে তারাই নির্বাচন নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে’ (সমকাল অনলাইন, ১ জানুয়ারি ২০২৫)।
‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’ বলতে যদি কেবল নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে বোঝানো হয়, তাহলে এটিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘিরে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক মেরূকরণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের অস্থিরতাকে প্রশ্নের মুখে রাখলেও এটা পরিষ্কার– জনসমর্থন ছাড়া এই প্রক্রিয়া কখনও টেকসই হবে না। কেননা, গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক দল গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে জনসমর্থন। এটা আর যা-ই হোক সরাসরি ক্ষমতায় থেকে কিংবা ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না।
আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আচরণের ওপর। সে ক্ষেত্রে ‘নতুন রাজনৈতিক শক্তি’র উদ্যোগ কতটা গণতান্ত্রিক এবং কতটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে, সেটাও বড় মাপকাঠি।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
- বিষয় :
- মতামত