ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

স্মরণ

বিশ শতকের অন্যতম বিচারক

বিশ শতকের অন্যতম বিচারক

বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ (১৯১১–১৯৭৯)

নাজির আহমদ

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৪৪

ভারতীয় উপমহাদেশে আইনাঙ্গনে আছেন কিন্তু বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের নাম শোনেননি– এমন কাউকে সম্ভবত পাওয়া যাবে না। ইংল্যান্ডে লর্ড ডেনিং ছিলেন বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারক। বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন বিশ শতকের দক্ষিণ এশিয়ার লর্ড ডেনিং।

বিচারপতি মোর্শেদের পুরো নাম সাইয়্যেদ মাহবুব মোর্শেদ। জন্ম ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি। তাঁর বাবা ছিলেন সাইয়্যেদ আবদুস সালিক, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সফল একাডেমিক ক্যারিয়ার সমাপ্তির পর বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং পরে বগুড়া ও দিনাজপুরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মা ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের বোন আফজালুন্নেছা বেগম। ১৯৩৯ সালে বিচারপতি মোর্শেদ কলকাতার সাবেক মেয়র ভারতীয় প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ জাকারিয়ার মেয়ে লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন পুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছেন, সবাই উচ্চশিক্ষিত ও দেশ-বিদেশে সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিচারপতি মোর্শেদ ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগ থেকে প্রথম স্থান লাভ করেন। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ১৯৩০ সালে বিএ (সম্মান) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে তিনি বার-অ্যাট ল হন।

শিশুকাল থেকেই সাহিত্যে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক। বিগত শতকের চল্লিশের দশকে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে তাঁর সমালোচনাধর্মী প্রবন্ধ বিচারপতি মোর্শেদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহলে উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটিতে নেতৃত্ব দেন। ছাত্রজীবনে খেলাধুলার প্রতিও তাঁর ঝোঁক ছিল। তিনি গত শতকের ত্রিশের দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদ চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালের প্রথম দিকে ঢাকা হাইকোর্টে তাঁকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডহক বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রবাদপ্রতিম সাহসিকতা ও প্রচণ্ড সাহসী রায় তৎকালীন সরকারকে ঘাবড়ে দিয়েছিল। তাই সরকার বিভিন্নভাবে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। 

কিন্তু বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষ। যখন দেখেছেন বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে বিচার করতে পারছেন না, তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৬৭ সালের ১৬ নভেম্বর। পদত্যাগের পর বিচারপতি মোর্শেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ডিফেন্সকে সংগঠিত করতে সহযোগিতা করেন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করেন। আইয়ুব খানের ডাকা রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের ১১ দফার পক্ষে ওকালতি করেন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের ২১ দফা ড্রাফটিংয়ে ভূমিকা ছিল তখনকার তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী বিচারপতি মোর্শেদের। এই ২১ দফাকে সামারাইজ করে ছয় দফায় রূপান্তর করেছিলেন বিচারপতি মোর্শেদ।

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিটি অংশের জন্য পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ১৫০টি সিট ছিল। কিন্তু যখন বিচারপতি মোর্শেদের ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ কনসেপ্ট সম্পর্কিত প্রস্তাব গৃহীত হলো, তখন পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পেল ১৬৯টি। অন্য কথায়, বিচারপতি মোর্শেদ এই রাস্তা পরিষ্কার করেছিলেন– পূর্ব পাকিস্তানে যে-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে, সে-ই জাতীয় পর্যায়ে সরকার গঠন করবে।  আইনের জগৎ ও তার বাইরে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বিচারপতি মোর্শেদ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল ইহলোক ত্যাগ করেন।

নাজির আহমদ: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার

আরও পড়ুন

×