ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘ইনসাফ’ ধারণা

রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘ইনসাফ’ ধারণা

ইফতেখারুল ইসলাম

ইফতেখারুল ইসলাম

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৩:৪৫ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১২:২১

ঔপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলোতে পাশ্চাত্য আধিপত্য এতই প্রবল যে, নাগরিকদের এই আধিপত্য এড়িয়ে নিজ জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে চিন্তা করতেও হিমশিম খেতে হয়। পরদেশি শাসক সশরীরে হাজির থাকে না বটে, কিন্তু মন ও মগজে তার উপস্থিতি যুগ যুগ ধরে রয়ে যায়। বাংলাদেশের বিশেষত বিদ্যাচর্চায় এ ধারা এখনও প্রকট।

সম্প্রতি ‘বাংলা বদ্বীপের ইতিহাস মেরামতি: কিছু দিকচিহ্ন’ শিরোনামে জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক বক্তৃতা আয়োজন করে। বক্তা ইউনিভার্সিটি ব্রুনেই দারুসসালামের সহকারী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও রাষ্ট্রধর্ম প্রশ্নে তিনি বলেন, স্রেফ ‘গণতন্ত্র’ রাখলেই হতো। নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও লেখক সারোয়ার তুষারও আবুল মনসুর আহমদের কথা টেনে একই মত দেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গভীরে গিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি। 

আগের এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম, সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা আনার যেমন দরকার ছিল না, তেমনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করারও প্রয়োজন ছিল না। মূলত গোড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করার কারণে পরে ‘প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গটি এসেছে। ফলে বিতর্ক মিটে যায়নি।

দশকের পর দশক রাষ্ট্রনীতির মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বোঝা যায়, আমরা এসব ধারণা ও বর্গ এই মাটি ও জনগোষ্ঠীর নিরিখে বিচার করতে পারিনি। আমরা এখানকার জনগোষ্ঠীর ভূরাজনীতি ঐতিহাসিক নিরিখে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র প্রকল্প হাতে নেওয়ার চেষ্টাও করিনি।
বলা প্রাসঙ্গিক, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা পাশ্চাত্যজাত। ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলিম বর্গ যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এখন প্রশ্ন হলো, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি কীভাবে নির্ধারণ করব?

কবি ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার উল্লেখ করেছেন, ষাটের দশকে তাদের স্লোগান ছিল– ‘প্রথম বিপ্লবের খুন বেরোবে ভাষা থেকে’। ষাটের দশকে শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা পৃথিবী উত্তাল ছিল। রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। একদিকে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামীদের লড়াই, যেমন– আলজেরিয়া এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে; অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে আমেরিকাপন্থি ও সোভিয়েতপন্থিদের সংঘাত, যেমন– ভিয়েতনাম। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শুভ বসু তাঁর ‘ইনটিমেশন অব রেভলিউশন: গ্লোবাল সিক্সটিজ অ্যান্ড দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে।

বাংলাদেশ ও পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠী নিয়ে বহু গবেষণায় ভাষার প্রশ্নটি উঠে এসেছে। ভাষার পুনর্গঠন প্রশ্নে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এমনকি হাল আমলের অনেক গবেষক ও তরুণ প্রাবন্ধিকের মধ্যে বাংলা ভাষা পুনর্গঠনের আলোচনা উল্লেখযোগ্য। একটি নজির দীপেশ চক্রবর্তীর সম্মাননায় ইউপিএল প্রকাশিত ‘সময়ের কুয়াশায়’ বইটি। এতে তৈমুর রেজার লেখাটি দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমসহ অনেকের লেখায়ই ভাষা পুনর্গঠনের লক্ষণ চোখে পড়ে। এমনকি গত দেড় দশকে এ বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা মাথায় না রাখলে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির প্রেক্ষাপট বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে যাবে। বহুল আলোচিত পাঠচক্রগুলোর কথা বিস্তারিতভাবে না-ই বা বললাম। 

যাহোক, রাষ্ট্রের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম প্রশ্নে ইফতেখার ইকবাল ও সারোয়ার তুষার (আবুল মনসুর আহমদের বরাতে) বলেছেন, কেবল গণতন্ত্র রাখলে দুই প্রশ্নেরই মীমাংসা হতো। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ বিষয়টিও সরলরৈখিক নয়। আমরা জানি, আজকাল সবচেয়ে বড় কর্তৃত্ববাদী শাসকও গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায়। এশিয়া, আফ্রিকাসহ দুনিয়ার নানা প্রান্তে এর নজির রয়েছে। এমনকি যে অঞ্চলে গণতন্ত্র ধারণাটির উৎপত্তি, সেখানেও ক্ষমতাসীনরা একই কায়দায় গণতন্ত্রের নামে জুলুম জারি রেখেছে। যেমন– যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সবক দিলেও গাজায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। বরং ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডে দেশটির সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। 

মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য গণতন্ত্রের পশ্চিমা ধারণা দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের নিজস্ব ভাষা থেকে এই মীমাংসার পথ খুঁজতে হবে। তাহলে ‘গণতন্ত্র’ কথাটার চেয়ে কার্যকর ভাষা কী হতে পারে, যা ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম প্রশ্নে মীমাংসা দিতে পারে?

জোর দিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা নিজ জনগোষ্ঠীর মাটি থেকে উদ্ভূত হওয়া জরুরি। আমরা রাষ্ট্রের মূলনীতি প্রশ্নে ‘ইনসাফ’ যুক্ত করতে পারতাম। কিন্তু কেউ কেউ মনে করতে পারেন, শব্দটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত। এ ধরনের চিন্তাও ঔপনিবেশিক কাঠামোর ফসল। মূলত ইনসাফ ও ইনসাফের ধারণা এখানকার জনগোষ্ঠীর রক্ত ও মর্ম থেকেই উদ্ভূত। বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত নয়; বরং এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও দৈনন্দিন লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তথাকথিত মূলধারার জ্ঞানচর্চায় উৎপাদক জনগোষ্ঠীর ভাষা উপেক্ষিত হওয়ার কারণে ইনসাফের ধারণা স্রেফ আইন-আদালতে সীমাবদ্ধ থেকেছে। 

যেমন– একজন দিনমজুরের কাছে গণতন্ত্রের ধারণা বোধগম্য করা হিমালয়ে তোলার মতো। অথচ একই ব্যক্তি ইনসাফের ধারণা দিয়ে তার সামাজিক ন্যায়বিচার বোঝে। যেমন রহিম যদি করিমকে বলেন, অমুক আমার সঙ্গে ইনসাফ করেনি, সেখানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা বহুধাবিস্তৃত হয়; গণতন্ত্রের ধারণার চেয়ে তাদের কাছে অনেক বেশি আপন ও বোধগম্য হয়। বস্তুত ইনসাফের ধারণা দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচারের বাইরেও প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মানবসমাজের দায়িত্ব উঠে আসে। 

যারা বলেন, গণতন্ত্রের ধারণা দিয়েই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ধর্মনিরপেক্ষতা বা রাষ্ট্রধর্ম প্রশ্নের মীমাংসা করা যেত, তারা হয়তো লক্ষ্য করেন না যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে গণতন্ত্র ছিলই। এখন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ইনসাফ হতে পারে এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মোক্ষম ধারণা।

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
iftekarulbd@gmail.com
 

আরও পড়ুন

×