সমাজ
বাংলাদেশকে যেন ‘হ্যাটলেন সিনড্রোম’ না পায়
আবু এন এম ওয়াহিদ
আবু এন এম ওয়াহিদ
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:২৫ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৩৪
উনিশশ চুরানব্বই সালে হলিউড থেকে ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা মুক্তি পায়। সেটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। আমেরিকার একেবারে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত ‘মেইন’ অঙ্গরাজ্যের একটি কারাগারের নাম ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজন’। চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টায় ওই কারাগারে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এ সিনেমার বিষয়বস্তু। কারাগারের নিরাপত্তাকর্মী, প্রধান কারাকর্মকর্তা, তাদের নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতি এবং কারাগারের অসংখ্য কয়েদির সুখ-দুঃখের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে নির্মিত এ ছবি। কাহিনিটি লিখেছেন স্টিভেন কিং এবং এর পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট। দু’জনই নিজ নিজ জগতে সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
সিনেমাটির একটি চরিত্র ব্রুকস হ্যাটলেন। ছবির গল্প অনুযায়ী দীর্ঘ ৫০ বছর কারাভোগ করার পর ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে হ্যাটলেন জেল থেকে ছাড়া পান। অর্থাৎ তিনি ১৯১৫-১৬ সালের দিকে ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজন’-এ কারাজীবন শুরু করেন। জেলখানায় কয়েদিদের জন্য একটি ছোট্ট লাইব্রেরি ছিল। হ্যাটলেন ছিলেন এর লাইব্রেরিয়ান। কারামুক্তির পর হ্যাটলেন বেঁচেছিলেন মাত্র অল্প কিছুদিন। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন, একেবারে একাই ছিলেন। মুক্ত হওয়ার পর তিনি যেদিকে যেতেন, শুধু অবাক হয়ে দেখতেন ৫০ বছরে সবকিছু কীভাবে বদলে গেছে! সমাজ, দেশ, দেশের মানুষ, মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবন-জীবিকা, এমনকি রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সবকিছুতেই তিনি আমূল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর আশপাশের কোনো কিছুই তিনি আর চিনতে পারছিলেন না।
তবে মুক্তজীবনে তাঁর কাছে কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। কারাগারে যাওয়ার আগের কথা বলতে গিয়ে তিনি একসময় বলেছেন, ‘ছোটবেলা আমি একটি গাড়ি দেখেছিলাম। এখন সব জায়গায় খালি গাড়ি আর গাড়ি! যেখানে যাই সেখানেই গাড়ি। গাড়ির জন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে সাহস পাই না।’ কী ঘরে, কী বাইরে সবসময় তিনি ভয় ও আতঙ্কের মধ্যেই থাকতেন!
এ রকম এক মানসিক অবস্থায় হ্যাটলেন নিজেকে নিজে বলছেন, ‘আই ওয়ান্ট টু কমিট অ্যানাদার ক্রাইম, সো দ্যাট দে উইল সেন্ড মি হোম।’ অর্থাৎ তিনি আরেকটি অপরাধ করতে চান, তাহলে আইন-আদালত তাঁকে ‘বাড়ি’ পাঠিয়ে দেবে। টানা ৫০ বছর কারাগারে থেকে হ্যাটলেন কারাগারকেই মনে করছেন তাঁর ‘বাড়ি’ আর মুক্ত জীবনের বাসগৃহকে মনে করছেন যন্ত্রণাদায়ক ‘কারাগার’!
এটি হ্যাটলেন জেলজীবনের শেষ দিকে বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি এক কয়েদির গলায় ছুরি ঢুকিয়ে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যাতে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর মুক্তির আদেশ বাতিল করে আবারও যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়ে দেয়। সহকয়েদিদের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের কারণে হ্যাটলেনের সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। তিনি সময়মতো মুক্তি পেয়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ মুক্ত জীবনে ফিরে আসেন।
কিন্তু দিন দিন এ জীবন হ্যাটলেনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। জেলে (তাঁর ভাষায় নিরাপদ ও শান্তিময় আপন ঘর) ফিরে যাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করতে না পেরে হ্যাটলেন আত্মহত্যা করেন। হ্যাটলেন সিনেমার মূল চরিত্র ছিলেন না। ফলে তাঁর মৃত্যুতে ছবির গল্পটি শেষ হয়ে যায়নি। মূল চরিত্রের ঘটনাবলি নিয়ে তারপরও কাহিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’ নায়িকাবিহীন পরিচ্ছন্ন একটি বিরল ছায়াছবি।
যাক, যে কারণে হ্যাটলেনের প্রসঙ্গ এলো, এবার আসি সেই কথায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। চড়াই-উতরাই পার হয়ে দেশ অনেক দূর এগিয়েও এসেছে। স্বাধীনতার পরপর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সরকার বাজেট দিয়েছিল মাত্র ৭৮৫ কোটি টাকার। এখন সেই বাজেট হয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। আগে বাংলাদেশিদের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের নিচে। এখন সরকারি ভাষ্যমতে, সেটি উঠে এসেছে ২ হাজার ৮০০ ডলারের ওপরে। সাক্ষরতা, শিশুমৃত্যু, নারীর কর্মতৎপরতা, ক্ষমতায়ন, মানুষের গড় জীবন প্রত্যাশা, এমডিজি, এসডিজি ইত্যাদি আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।
তারপরও সোনার দেশের রয়ে গেছে অনেক ব্যর্থতা। অনেক হতাশা ও অনেক বঞ্চনা। বারবার প্রতারিত হওয়ার পর অনেক আশা করে মানুষ ২০০৮ সালে ভোট দিয়েছিল। বিনিময়ে তারা পেয়েছে প্রতারণা, প্রহসন ও জালিয়াতির ভোটাভুটি। একটা ভঙ্গুর ও অতি নড়বড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ হলেও আগে জনগণ ছিল অন্তত এক দিনের ‘বাদশাহ’। পাঁচ বছর পরপর ভোট দিয়ে সরকার বদলাতে পারত। ২০০৮-এ ‘দিন বদলের সরকার’ এসে জাতীয় ও স্থানীয় সব স্তরে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে নিল। নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের আর ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যেতে হয় না। ভোটেরই দরকার পড়ে না। সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জিতে যাওয়া। তাই ভোট গ্রহণের আগেই সরকার গঠন হয়ে যায়। পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় মাস্তান ব্যবহার করে দিনের ভোট রাতেই করে ফেলা যায়।
সব শেষে হলো ‘আমি-তুমি-ডামি’ নির্বাচন। সফল একতরফা নির্বাচনের পর সরকার ছিল নির্ভার। ছিল স্বস্তিতে। গত জুনে হঠাৎ ঈশান কোণে দেখা দিল ঘন কালো মেঘ। শুরু হলো অরাজনৈতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন। কোটা আন্দোলন গড়াতে গড়াতে গড়িয়ে গেল এক দফার আন্দোলনে। এতে দফারফা হয়ে গেল হাসিনা সরকারের। জাতীয় ঐক্যের শক্তির ধাক্কায় হাসিনা দলবলে পালাতে বাধ্য হলেন।
দিনে দিনে সেই ঐক্যেও ফাটল দেখা দিল। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের প্রতি সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের আনুগত্যে বড় রকমের ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল। ফলে প্রত্যাশিত জাতীয় সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন দারুণভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ে গেল।
বর্তমানে আলামত যা দেখছি, তাতে আমার মনে হয় না, অদূরভবিষ্যতে আমরা একটি সুস্থ-সুন্দর বাংলাদেশ পাব। ধরে নিলাম দশ-বিশ বছর পর কোনো লৌকিক কিংবা অলৌকিক কারণে সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। অর্থাৎ দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেল। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এলো। সীমাহীন দুর্নীতির পরিবর্তে ধীরে ধীরে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। সর্বস্তরে ন্যায়নীতি ও মানবিক মূল্যবোধ ফিরে এলো। সত্যি সত্যি সব জায়গায় আইনের শাসন কায়েম হয়ে গেল। মানুষে মানুষে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হলো। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলার সুবাতাস বইতে আরম্ভ করল।
সেই অবস্থা আমরা জীবনে দেখে যেতে পারব কিনা জানি না, তবে এমন দিনে, আমার ভয় হয়, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’-এর হ্যাটলেনের মনের মতো হয়ে যায় কিনা! অর্থাৎ দীর্ঘদিন অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর ও খারাপ পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষের কাছে ‘খারাপ’-কে ভালো এবং ‘ভালো’-কে খারাপ মনে হতে পারে। আমার শঙ্কা অমূলক হোক! বাংলাদেশের জনগণ ‘হ্যাটলেন সিনড্রোম’ থেকে মুক্ত থাকুক। নিরাপদ থাকুক। এ ইচ্ছা ব্যক্ত করেই এ নিবন্ধের ইতি টানছি।
আবু এন এম ওয়াহিদ: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর: জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
wahid2569@gmail.com
- বিষয় :
- সমাজ