ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় যা জরুরি

উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় যা জরুরি

প্রতীকী ছবি

বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৩৪

উপকূলীয় অঞ্চল বলতে সমুদ্রতীরবর্তী বা উপকূল রেখা বরাবর এলাকাকে বোঝায়। পৃথিবীতে প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। উপকূলীয় এলাকাকে ঘিরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। নানা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই উপকূল এলাকা। একে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখানে বিশাল অংশের মানুষ মৎস্যজীবী। প্রায় ২৮ প্রজাতির চিংড়িসহ ১৮৭ প্রজাতির মাছ শিকার করা হয় উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় অঞ্চলের ১১ হাজার ৫০০ হেক্টরজুড়ে রয়েছে চিংড়ি চাষ। কক্সবাজারে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। এই অঞ্চলেই নৌবাণিজ্য ও নৌপরিবহন হচ্ছে। এ ছাড়া জাহাজ ভাঙা শিল্প, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এসব তো আছেই। বাংলাদেশে জনসংখ্যার বেশি ঘনত্বের কারণে এসব অঞ্চলে পরিবেশগত নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। বাড়ছে মৎস্যজীবীর সংখ্যা। এ ছাড়া উপকূলীয় সম্পদের অতিব্যবহার, পানিদূষণ, ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস ইত্যাদি 
লেগেই আছে।    

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর ৪৪ শতাংশ মানুষ সমুদ্রের ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে। এসব এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি থাকে। বন্দরসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখানে ঘটে। এসব কর্মকাণ্ড পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে; যা উপকূলীয় পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। 
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকার ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি লবণাক্ত জল প্রবেশ করছে নানা জায়গায়। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। সামুদ্রিক দূষণ হচ্ছে। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।   

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ১০ বছরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় ৩৯ শতাংশ বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মিরসরাইয়ে বনভূমির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৬১ হেক্টর। ১৯৯৭ সালে সব বন মিলিয়ে এর পরিমাণ হয়েছে ৭ হাজার হেক্টর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলের বন প্রতিনিয়ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেমন বনাঞ্চল বিলীন হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় প্রভাবশালীরা নির্বিচারে ধ্বংস করে যাচ্ছে এসব বন। মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের তিন সহস্রাধিক একর প্যারাবন কেটে ছোট-বড় অর্ধশত চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা– সম্প্রতি একটি পত্রিকায় এমন প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে । 

সত্য, সরকার বসে নেই। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে বনায়ন করা হয় ১৯৯৭ সালে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ প্রায় ৫ লাখ একর উপকূলীয় বনায়ন করে। বলা হয় এটিই প্রথম বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্প।  বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকায় যেসব চর জেগে উঠেছে, সেসব চর এলাকায় ১৯৬৫ সাল থেকে বন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব বনকে প্যারাবন বলা হয়। এই প্যারাবন গড়ে উঠেছে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর এবং কক্সবাজার জেলায়। এই বন নানাভাবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জানমাল ও দেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে। প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর ভূমিতে এই বন তৈরি করা হয়েছে যা দেশের আয়তনের ১.৩৬ শতাংশ। 

উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা করতে হলে কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট রুলস এবং স্পেশাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা দরকার। এখানকার কৃষিজমি সুরক্ষায়ও আইন প্রণয়ন করা দরকার।  ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করা প্রয়োজন। অন্তত উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত।   মোট কথা, একটি সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি, যেখানে বসবাসরত মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উভয়েরই উন্নয়ন হবে।  

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : শিক্ষক ও গবেষক

আরও পড়ুন

×