অধিকার
সভা-সমাবেশ বনাম চলাফেরার স্বাধীনতা
প্রতীকী ছবি
মো. মোস্তাফিজার রহমান
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৩৮ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৩৮
সমাবেশের স্বাধীনতার কারণে যখন চলাফেরার স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় তখনও মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদে জনগণের চলাফেরার
স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইন মোতাবেক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরা এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে, যা জনগণের মৌলিক অধিকার।’
আবার ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করার অধিকার রয়েছে। তাহলে দাঁড়ালো কী? সংবিধানে বর্ণিত ওই দুটি মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। একটি মৌলিক অধিকারের কারণে; আরেকটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হওয়া জনস্বার্থের পরিপন্থি, সেটি হতে পারে না। সে কারণেই সংবিধানের ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকগণের সভা-সমাবেশ করার অধিকারের ক্ষেত্রে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। আমরা দেখছি, সভা-সমাবেশ করার অধিকার আদায় করতে গিয়ে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতাকে প্রায়ই ভূলুণ্ঠিত হয়।
সংবিধানে বর্ণিত ওই দুটি মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি আমার মনে হয় আজকাল সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে দাবি আদায়ের মৌসুমের প্রভাবে সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা চলাফেরার স্বাধীনতাকে নিরন্তর হরণ করে চলেছে। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধের বিষয়টি অকার্যকর হয়েছে।
অযৌক্তিকভাবে মানুষের একটি মৌলিক অধিকার আদায়ের কারণে আরেকটি মৌলিক অধিকারকে হরণ করা হচ্ছে। দাবি আদায়ের আন্দোলনের নামে ঢাকার জনজীবনের বিশৃঙ্খল ওই পরিবেশ দেশে ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। সাম্প্রতিককালে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সভা-সমাবেশের স্বাধীনতার নামে চলাফেরার স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে সমাজকে অস্থিতিশীল করা এবং অর্থনীতির গতিকে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে মর্মে জনমনে হতাশা তৈরি হয়েছে। মানুষ সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ওই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের অবসান চায়। সেটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্বও বটে।
মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য জ্ঞান করি। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট স্থানে দাবি আদায়ের আন্দোলনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। সেখানে রাষ্ট্রের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতির নিশ্চয়তা বিধান করা চাই, যাতে করে আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়ে সরকার, মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওয়াকিবহাল থাকতে পারে। চলাফেরার স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিতে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করার সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনে আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি জনদাবি বা জনমত প্রকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে একটি নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভূত হয়। সেজন্য সকল দল, গোষ্ঠী ও সংগঠনের আন্তরিকতা জরুরি। সংবিধানে এমন অনেক ক্ষেত্রে অসংগতি দূর করার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার করা জরুরি। সংবিধানের এমন সংস্কার হওয়া উচিত, যাতে সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করার কারণ হতে না পারে। সেজন্য গণসচেতনতা সৃষ্টি করা ও শক্তিশালী জনমত জরুরি মনে করি। এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের শুভদৃষ্টি কামনা করি।
কমিশন এ বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে। যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হন তাহলে সেক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ব্যক্তির সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টে রিট আবেদন করার অধিকার রয়েছে। এমন একটি জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনদাবি পূরণের লক্ষ্যে সচেতন বিবেকবান নাগরিকদের আইনের আশ্রয় নেওয়া বা রিট আবেদন দায়ের করা সামাজিক দায়বদ্ধতা বিবেচনা করি। উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সরকার ওই জনদুর্ভোগ কমাতে ব্যবস্থা নিতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের শুরুতেই ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। যদি করা হয় তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি আগের সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। তাহলে বিদ্যমান সংবিধানে সভা-সমাবেশ-সংশ্লিষ্ট মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে গিয়ে যখন মানুষের চলাফেরা-সংশ্লিষ্ট মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। অর্থাৎ একটি মৌলিক অধিকার পূরণ করতে গিয়ে যদি আরেকটি মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত হয় তখন সংবিধান সংস্কার করা যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হয় । তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারে চলাফেরার স্বাধীনতা সুরক্ষায় সংবিধান সংস্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সংস্কার কমিটি সে বিষয়ে দৃষ্টি দেবে নিশ্চয়।
ড. মো. মোস্তাফিজার রহমান: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, নওগাঁ সরকারি কলেজ
- বিষয় :
- অধিকার