জলবায়ু
ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল যে শিক্ষা দিল
নাভিদ সালেহ
নাভিদ সালেহ
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৩৯
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া জ্বলছে। পাঁচটি দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। এর ভেতর পালিসেড দাবানল প্রথম ও প্রধান। পরে আরও চারটি জায়গায় আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এসব জায়গার নামানুসারেই দাবানলের নাম দেওয়া হয়েছে। এ দাবানলের ব্যাপ্তি প্রায় ৩৭ হাজার একর বা ৫৮ বর্গমাইলে গিয়ে পৌঁছেছে। প্রায় এক লাখ অধিবাসী ঘরছাড়া হয়েছেন। ১৩ হাজারের বেশি বাড়ি, দালান ও স্থাপনা আগুনে ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিতে। প্রশ্ন উঠেছে, এই আগুন লাগল কেন? এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত কতটুকু কিংবা নগরের দাবানলের সঙ্গে গভীর বনানীতে লাগা আগুনের তফাত কোথায়, সে প্রশ্নও উঠেছে। নগরের দাবানলের চ্যালেঞ্জই বা কী, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
প্রথমেই বলা দরকার, বিশেষত ইউক্যালিপটাস ও ওক গাছে ভরপুর হওয়ায় ক্যালিফোর্নিয়া যেখানে অবস্থিত, যুক্তরাষ্ট্রের সেই পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলে গাছপালা অধিকতর দাহ্য। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় আগুন লাগার পেছনে বজ্রপাত, বৈদ্যুতিক সংযোগে দুর্ঘটনা ও দুষ্কৃতকারী কর্তৃক অগ্নিসংযোগকেই দায়ী করা হয়েছে। ওই দাহ্য গাছের উপস্থিতি আগুন ছড়িয়ে পড়তে ইন্ধন হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৮০ সালের পর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে নগরায়ণের অতিবৃদ্ধি ঘটেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।
ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে প্রায় আড়াই কোটি একর এলাকা– রাজ্যটির প্রায় এক-চতুর্থাংশ– মরুভূমি। মরুভূমির শুষ্কতা ও তাপমাত্রার আধিক্য নিম্ন বায়ুচাপের কারণ হয়। অন্যদিকে রাজ্যটির পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, যেখানে তাপমাত্রা কম এবং জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। এ অঞ্চলে তাই উচ্চ বায়ুচাপ বিরাজ করে। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উচ্চ চাপযুক্ত বায়ু উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া দিয়ে ধাবিত হয় এবং নেভাদাসহ আরও তিনটি রাজ্য অতিক্রম করে ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণে মরুভূমির দিকে এগোতে থাকে। এই চক্রাকার বায়ুপ্রবাহ ‘সান্তা আনা’ নামে পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা ও জলীয়বাষ্পের তারতম্য বেড়েছে, যা সান্তা আনা বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ তীব্রতর করেছে। বাতাসের এই তীব্রতা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে। ফলে দাবানলও দীর্ঘায়িত ও প্রলম্বিত হয়।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস একটি মহানগর। এই বিস্তৃত নগর নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর অধিবাসীদের অবস্থান আগুনের ঝুঁকি বাড়ায় মূলত তিনভাবে। প্রথমত, নগর তৈরির জন্য বনানী উজাড় করতে হয়। দ্বিতীয়ত, নগর তৈরি হওয়ার পর এর অধিবাসীদের স্বাস্থ্য চিন্তা থেকে আশপাশের বনানীর দাহ্য গাছে নিয়ন্ত্রিত আগুন লাগিয়ে তা পোড়ানো যায় না। অথচ অগ্নিব্যবস্থাপনার একটি পরিচিত ও জরুরি পদক্ষেপ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে দাহ্য জ্বালানির দহন। তৃতীয়ত, নগরে দাবানল ছড়িয়ে পড়লে অনেক বড় একটি জনগোষ্ঠী, তাদের বাড়িঘর ও সম্পদ ঝুঁকির মুখে পড়ে। এতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বাড়ে অনেক।
এবারের দাবানলের পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। রাজ্যটির আবহাওয়া অধিদপ্তর কয়েকটি কারণকে ইতোমধ্যে নাকচ করে দিয়েছে। যেমন– পালিসেড এলাকায় কোনো বজ্রপাত হয়নি গত কয়েকদিনে। বৈদ্যুতিক সংযোগে কোনো দুর্ঘটনার রিপোর্টও এখন পর্যন্ত নেই। ধারণা করা হচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ অনাবৃষ্টি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে পড়ে। তাই শুকনো পাতায় পাতায় ঘষা লেগে এই আগুনের উৎপত্তি হয়, যা সান্তা আনা বায়ুপ্রবাহ থেকে ইন্ধন পায় এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনেকটা হাপরে বাতাস দেওয়ার মতো উচ্চগতিসম্পন্ন সান্তা আনা বায়ুপ্রবাহ বিস্তৃতি ঘটিয়েছে এই দাবানলের।
যেহেতু লস অ্যাঞ্জেলেস ও তৎসংলগ্ন এলাকা হয় মহানগরের অংশ বা তার শহরতলি, বাড়িঘরগুলোর সামনে ৫০০-৬০০ ফুট পরপর ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসানো থাকে। পালিসেড এলাকায় তিনটি পানির ট্যাঙ্ক মোট ৩০ লাখ গ্যালন পানি ধারণ করতে পারে এবং তা এই ফায়ার হাইড্র্যান্টগুলোতে সরবরাহ করার কথা ছিল। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এবং শত শত বাড়িতে প্রায় একই সময়ে আগুন লাগায় তিন-চার গুণ বেশি পানির প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে অনেক ফায়ার হাইড্র্যান্ট পানির অভাবে অগ্নিনির্বাপণে ব্যর্থ হয়। বলা হচ্ছে, রাজ্যটির পানি ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণ। যদিও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা প্রতুল ছিল বলে দাবি করছে নগর কর্তৃপক্ষ। ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসীরা এ অনিয়ন্ত্রিত আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘটনা থেকে আমাদের কী শেখার আছে? প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেহেতু তাপমাত্রা ও জলীয়বাষ্পের তারতম্য ঘটছে, তাই নগর অঞ্চলের কাছাকাছি পাতা বা বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার। আগে এমন নিয়ন্ত্রিত দহন থেকে আগুন ছড়ায়নি। সেই অবস্থা সবসময় থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিচর্যা দরকার, যাতে সেখান থেকে আগুন না ছড়ায়। পাশাপাশি দাহ্য পদার্থ, বিশেষভাবে রান্নার জন্য ব্যবহৃত গ্যাসের ট্যাঙ্ক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির সরবরাহ নিশ্চিত রাখা দরকার। ঢাকার মতো শহরে পানির অপ্রতুলতার সঙ্গে যোগ হয় আগুন নেভানোর গাড়ি যথাস্থানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা। পর্যাপ্ত পানির উপস্থিতি এবং এর সরবরাহ নিশ্চিত করতেই হবে। ফায়ার হাইড্র্যান্ট পরিকল্পিতভাবে বসাতে হবে। সেগুলো যেন সচল থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, যে এলাকায় আগুন লেগেছে, সেখান থেকে অধিবাসীদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট আয়োজন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের থাকতে হবে। পরিশেষে নগরবাসীর পক্ষ থেকে অগ্নিনিয়ন্ত্রণ ও উপযুক্ত অগ্নিব্যবস্থাপনার দাবি জানাতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ একুশ শতকের পৃথিবীতে মানুষের জীবন ও সম্পদ আগুনে ভস্ম হবে– এটি মেনে নেওয়া যায় না।
নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক।
- বিষয় :
- জলবায়ু