ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

তৃতীয় মেরু

সীমান্ত সংঘাতের ‘মধ্যস্রোত মামলা’

সীমান্ত সংঘাতের ‘মধ্যস্রোত মামলা’

শেখ রোকন

শেখ রোকন

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৪১ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২২:৪২

বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তরেখায় গত এক সপ্তাহজুড়ে অন্তত চারটি এলাকায় বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনা চলছে; ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়, নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলায়, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলায়। 

আমরা জানি, বাংলাদেশ-ভারতের মতো জনঘনিষ্ঠ সীমান্তরেখা বিশ্বে কমই রয়েছে; পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদ দিলে বেশির ভাগ এলাকায় দুই দেশ এবাড়ি-ওবাড়ি মাত্র। তাতে করে সীমান্তরেখা যে 
কবি বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর’ হয়ে উঠেছে, এমন নয়। বরং বিশ্বের খুব কম সীমান্তই বাংলাদেশ-ভারতের মতো বিপজ্জনক। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের মতো ‘শত্রু রাষ্ট্র’ সীমান্তেও এত বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় না, যত বাংলাদেশি নিহত হন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর গুলিতে। সেই তুলনায় সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনাগুলো ততটা গুরুতর নয়। এমনকি আকস্মিকও নয়।

দেখা যাচ্ছে, উত্তেজনাস্থলগুলোতে ভারতীয় পক্ষ কাঁটাতার বসাতে চাইছে; আর বাংলাদেশি পক্ষ বলছে, কাঁটাতার বা যে কোনো স্থাপনা বসাতে হবে সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে দেড়শ গজ ভেতরে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শূন্যরেখার দুই পাশের তিনশ গজের মধ্যে কোনো পক্ষই স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। যদি স্থলভাগ হয়, তাহলে অসুবিধা নেই; শূন্যরেখা যদি জলভাগে পড়ে? 
দুই দেশের সংবাদমাধ্যম যদিও মহেশপুর ছাড়া বাকি এলাকা উল্লেখ করেনি; খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, চার এলাকাতেই উত্তেজনার মূলে রয়েছে সীমান্ত নদী। আরও ভেঙে বললে, সীমান্ত নদীর মধ্যস্রোতবিষয়ক জটিলতা।

ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত এলাকায় কোদলা নদী নিয়ে বিজিবি-বিএসএফ উত্তেজনার কারণ বরং খানিকটা সরলরৈখিক। নদীটি ওই উপজেলার শ্যামকুড় এলাকার শূন্যরেখা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার প্রায় শূন্যরেখা সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে একই উপজেলার মাটিলা সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করেছে। মানচিত্র অনুযায়ী, তৃতীয় ব্রাকেটের আকৃতির ওই নদীর অংশ বাংলাদেশেরই। স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিজিবি সেটি বুঝতে পেরে ‘দখলে’ নিয়েছে। লক্ষণীয়, বিএসএফ যদিও বিজিবির দাবি উড়িয়ে দিয়েছে, তারা সেখানে পাল্টা অবস্থান বা পদক্ষেপও নেয়নি। কারণ,

নথিপত্রে ওই অংশ বাংলাদেশেরই; সেখানে ভারতীয় কোনো স্থাপনাও নেই। 
সীমান্ত উত্তেজনার বাকি তিনটি ঘটনাস্থল ভিন্ন ভিন্ন জেলায় হলেও কারণ অভিন্ন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া দিতে এসেছে; বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি প্রতিবাদ করেছে বা বাধা দিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে দুই দেশের জনসাধারণ। 
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় ৪১শ কিলোমিটার সীমান্তরেখার প্রায় সর্বাংশে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে, সেখানে ওই তিন এলাকায় বিএসএফ ‘নতুন করে’ বেড়া বসাতে এসেছে কেন? বাকি সীমান্তে কাঁটাতার মেনে নিলেও ওই তিন এলাকায় বিজিবি প্রতিবাদ করছে কেন?

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের চৌকা সীমান্ত এলাকায় খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর উত্তর-পূর্ব দিক থেকে পাগলা এবং উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে গঙ্গা নদী শূন্যরেখা পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ঐতিহাসিক তথ্য যাচাই করলে দেখা যাবে, গত কয়েকশ বছরে ওই এলাকায় গঙ্গা কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পেন্ডুলামের মতো ডানে ও বামে গেছে। গঙ্গা-পাগলার মধ্যবর্তী অংশ তাই নবীন পলল ভূমি; বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়। যেখানে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া বসাতে চাইছে, তার পেছনে ভারতীয় অংশে যে ‘মরাগঙ্গা’ নদী এখনও রয়েছে, বোঝা যায় ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে- ‘মালদহের কালিয়াচক-৩ ব্লকের বাখরাবাদ পঞ্চায়েতের সুকদেবপুর বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি) থেকে সবদলপুর বিওপি পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় মরাগঙ্গা নদী থাকায় সেখানে বাংলাদেশ সীমান্ত কার্যত উন্মুক্ত’ 
(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০২৪)। 

বাংলাদেশি বা ভারতীয়, উভয় দেশের সংবাদমাধ্যম যদিও উল্লেখ করেনি, আমরা অনেকে জানি নওগাঁর ধামইরহাটের বস্তাবর সীমান্ত অতিক্রম করেছে আত্রাই নদী। নদীটি ভারত থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরে প্রবেশ করে ফের সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় প্রবেশ করেছে; পরে আবার নওগাঁ দিয়ে বাংলাদেশে এসে চলনবিলের মধ্য দিয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনায় মিলেছে। বস্তাবর সীমান্তে নদীটির কিছু অংশ দুই দেশের সীমান্তরেখা। ধারণা করি, এখানেও কাঁটাতার নিয়ে বিরোধের সূত্র এই নদী।

একই পরিস্থিতি লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বহুল পরিচিত দহগ্রাম সীমান্তেও। এই ‘ছিটমহল’ ইউনিয়নের উত্তর-পশ্চিম দিকে বহুল আলোচিত তিনবিঘা করিডোর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের অর্ধাংশজুড়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। শুধু তিস্তা নয়, গঙ্গা ও আত্রাইয়ের ক্ষেত্রেও এই প্রশ্ন উঠবে, যদি সীমান্তরেখা নদী হয়, তাহলে স্থাপনা বসবে কোথায়? 

প্রশ্ন হচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, লালমনিরহাট– তিন জেলাতেই কাঁটাতারের প্রশ্নে নদীর অবস্থান কেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল? এর মূলে রয়েছে বাংলাদেশ-
ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তির ‘মধ্যস্রোত মামলা’। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির ৫ ও ৬ নম্বর ধারায় যথাক্রমে মুহুরী ও ফেনী নদীসংলগ্ন সীমান্ত নির্ধারণ করার ফর্মুলা হিসেবে বলা হয়েছিল– ‘সীমান্ত চিহ্নিতকরণ কার্যক্রম চলাকালীন’ মধ্যস্রোতই হবে সীমান্তরেখা। 

চুক্তিটির এ ধারার মুশকিল দুটি। প্রথমত, ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতীয় আইনসভায় অনুসমর্থিত হতে হতে চার দশকের বেশি সময় লেগে গেছে। ততদিনে মুহুরী ও ফেনী নদী ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে ডান-বামে অনেকবার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। যেমন, ১৯৭৬ সালেই ত্রিপুরার বিলোনিয়া শহর রক্ষায় ভারত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করায় মুহুরী নদী ডানতীরে বা বাংলাদেশের দিকে ভাঙতে ও সরতে থাকে। ওপাশে চর জাগলে স্বাভাবিকভাবেই ভাঙনের আগের বাংলাদেশি মালিকরা ওই জমিতে গেছেন। তখন ভারত বলেছে, নদীর মধ্যস্রোত সীমান্ত হওয়ায় বামতীরে জেগে ওঠা ভূমি তাদের। এভাবে মুহুরী নদীর চর নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে অনেকবারই যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী ৯২ একর ওই চরের কমবেশি ৭২ একর বাংলাদেশ ও ২০ একর ভারতের সাব্যস্ত হয়েছে। 
দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে কী হবে, সেটি ওই চুক্তিতে বলা নেই। অথচ মুহুরী ও ফেনীর মতো সমস্যা তালিকাভুক্ত ৫৪ আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে অন্তত ১০টির ক্ষেত্রেও রয়েছে। তালিকাবহির্ভূত ৬৯টি আন্তঃসীমান্ত নদীরও অনেকের ক্ষেত্রে এ সমস্যা রয়েছে। যেমন ২০০১ সালের এপ্রিলে সিলেটের গোয়াইনঘাটে পাদুয়া সীমান্তে এবং কুড়িগ্রামের রৌমারীর বড়াইবাড়ি সীমান্তে ভূমির বিরোধ নিয়ে যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তার নেপথ্যে ছিল যথাক্রমে তালিকাভুক্ত পিয়াইন নদী এবং তালিকাবহির্ভূত দন্নী নদীর অবস্থান পরিবর্তন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, লালমনিরহাটেও বিরোধের কারণ যথাক্রমে গঙ্গা, আত্রাই, তিস্তা নদীর অবস্থান পরিবর্তন।

দেশভাগকালে যেভাবে নদীগুলোর অবস্থান অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, তার মাশুল আমরা এখনও গুনছি। স্থলসীমান্ত চুক্তিতে অবৈজ্ঞানিকভাবে মধ্যস্রোতকে টেনে আনায় সীমান্ত সংঘাতের ঝুঁকি সেধে নেওয়া হয়েছিল। বিলম্বে হলেও বিষয়টির মীমাংসা জরুরি। এক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোতে সীমান্ত চিহ্নিতকরণে আলোচনার মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতি ভাবা যেতে পারে। তার আগ পর্যন্ত গায়ের জোরে কাঁটাতার বসানোর চেষ্টা সংঘাতের ঝুঁকিই বাড়াবে কেবল। সেটি কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না। 

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com 

আরও পড়ুন

×