ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

আন্তর্জাতিক

গাজা পরিস্থিতি যে কারণে ইউক্রেনের তুলনায় গুরুতর

গাজা পরিস্থিতি যে কারণে ইউক্রেনের তুলনায় গুরুতর

ফাইল ছবি

মোশফেকুর রহমান

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০০:১৫

বিশ্বব্যাপী চলমান দুটি ভয়াবহ সংঘাত হলো ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ’ এবং ‘গাজা যুদ্ধ’। এ দুটি যুদ্ধ ভিন্ন অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক কারণে নির্মমতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। তবে প্রথমটিতে তুলনামূলক সামরিক মানদণ্ডে ভারসাম্য থাকলেও দ্বিতীয়টিতে একতরফা হামলা, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ঝনঝনানি সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, গাজা যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা কেন সাড়ে ১৯ মাস আগে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের তুলনায় এত বেশি এবং গাজার বাসিন্দারা কেন নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারছেন না? অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা কীভাবে সরে যেতে পেরেছেন?

একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মানবিক সংকটগুলো আমাদের সামনে আরেক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। সব যুদ্ধ কি একইভাবে কাঁদায়? ইউক্রেন ও গাজার দুই যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র স্পষ্ট করে, বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ও সহানুভূতির মানদণ্ড এক নয়। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের প্রতি সহানুভূতির জোয়ার; অন্যদিকে গাজার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যেন নিছক ‘নিরাপত্তা ইস্যু’ হিসেবে মূল্যায়িত।

তুলনামূলক যুদ্ধ দুটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাণহানির পরিসংখ্যানে গাজার বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি। অবরুদ্ধ ভূখণ্ডটির নারী ও শিশুরাই এর প্রধান শিকার। ইউনিসেফসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গাজায় নিহতের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক শিশু। পক্ষান্তরে ইউক্রেনে সামরিক-বেসামরিক হতাহতের অনুপাত তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ। ইউক্রেনের অধিকাংশ এলাকায় বেসামরিক হতাহতের হার তুলনামূলক কম। কারণ সেখান থেকে মানুষকে আগাম সরানো গেছে। ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুদের সাদরে আশ্রয় দিয়েছে। অন্যদিকে গাজায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে কিছু নেই। শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, স্কুল– সব ধরনের স্থাপনাই প্রতিনিয়ত হামলার লক্ষ্যবস্তু। সীমান্ত, বিদ্যুৎ, পানি, ওষুধ সরবরাহ– সবকিছুর ওপরে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা। 

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতেই লক্ষাধিক মানুষ পশ্চিম দিকে সরে যায়। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ সশ্রদ্ধ চিত্তে তাদের গ্রহণ করে। বিপরীতে গাজা একটি ‘ওপেন এয়ার প্রিজন’ বা উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে পরিচিতি পায়, যা আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে অবরুদ্ধ। এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও কোনো মানবিক করিডোর তৈরি হয়নি, যা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে।
ইউক্রেনে হামলার ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্ব (ন্যাটো জোট, ইইউ জোট ও যুক্তরাষ্ট্র) একযোগে নিন্দা জানিয়েছে। বিপুল পরিমাণে সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে কিয়েভের জন্য। ইউক্রেনের যোদ্ধাদের জাতীয় বীর হিসেবে তুলে ধরেছে অধিকাংশ গণমাধ্যম। অন্যদিকে গাজায় বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় ইসরায়েলের 
পক্ষে পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোর স্পষ্ট সমর্থন ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় পশ্চিমা গণমাধ্যমে গাজার জনগণকে হামাসের সঙ্গে মিলিয়ে প্রায়শ নিরাপত্তার ওপর হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। 

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চললেও জাতিসংঘের হিসাবে ইউক্রেনে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১০-১৫ হাজার মানুষ। প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের গাজা একটি সংকীর্ণ এবং বেষ্টিত উপকূলীয় ভূখণ্ড। উভয় সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া, সেনাচৌকি এবং অবরোধ কার্যকর থাকায় বেসামরিক নাগরিকদের বাইরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। সেই সঙ্গে আকাশ ও স্থলপথ উভয়ই নিয়ন্ত্রিত। 
ইউক্রেনের নাগরিকদের জন্য হামলার এলাকা থেকে সরে যাওয়া অনেক সহজ ছিল। কিন্তু গাজার বাসিন্দারা আদতে উন্মুক্ত আকাশের নিচে আটকে পড়া বন্দির মতো। গাজার নারী-শিশুরা দখলদার ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলার মুখে সেখানেই থাকতে বাধ্য হচ্ছে। গাজা ছাড়তে হলে ভিসা, নিরাপদ করিডোর ও শাসকগোষ্ঠীর অনুমতিপত্র প্রয়োজন, যা তাদের পক্ষে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এতে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিরুপায় ও অবরুদ্ধ এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় গাজাবাসী।

অপরদিকে ইউক্রেনীয়দের রাজনৈতিক অভিভাবক প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শিশু ও নারীদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেননি। প্রতিপক্ষের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় চাপানোর হীনচেষ্টা করেননি রাজনীতিতে অনেকটা অপরিপক্ব এই জেলেনস্কি। কিয়েভ সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে ইউক্রেনীয় নারী-শিশুদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।
গাজার হত্যাযজ্ঞ ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো সাধারণ জনগণের সরে যাওয়ার অধিকার এবং যুদ্ধাস্ত্রের ধরনে। ইউক্রেনের নাগরিকদের যেমন একটি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক কাঠামোর সহায়তা ছিল, গাজার মানুষের জন্য তেমন কোনো অবকাশ ছিল না। গাজা এখন সম্পূর্ণ ঘেরাওকৃত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষ শুধু আকাশপথে বোমা হামলায় নয় বরং মুসলিম বিশ্বের একাংশ এবং পশ্চিমাদের নীরবতাতেও প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।

মোশফেকুর রহমান: সংবাদকর্মী

আরও পড়ুন

×