সমকালীন প্রসঙ্গ
ব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষ সংস্কারেও উদ্যোগ প্রয়োজন

মো. সাইফুজ্জামান
মো. সাইফুজ্জামান
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ১৮:৪০
গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের চোখে নতুন দেশের একটি ছবি ভেসে বেড়িয়েছে। এখনও সে ছবি আছে, তবে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নানা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এখন এসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। দেখে মনে হচ্ছে কমিশনের সুপারিশগুলোতে ঐকমত্য পোষণ করলেই দেশ সংস্কার হয়ে যাবে আর মানুষের জীবনে নেমে আসবে অবারিত প্রশান্তি। কিন্তু এসব সুপারিশ কে বা কারা বাস্তবায়ন করবেন? এর জন্য তো সব ধরনের সংস্কারমুক্ত ন্যায়পরায়ণ নীতিবান মানুষ প্রয়োজন। সেই মানুষ হয়ে ওঠার কারখানা তথা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার উদ্যোগ কোথায়?
সংস্কার মানে কি শুধু কিছু আইন ও বিধি ব্যবস্থার পরিবর্তন? পুরোনো সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতায় যে জনআকাঙ্ক্ষা ছিল; তার অনেক কিছুই তো সংবিধানে ছিল এবং আছে। যেমন– সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদাবোধ কিংবা আইনের চোখে সবাই সমান। বিগত সময়ে এসবের কোনো বাস্তবায়ন ছিল কি দেশে? ছিল না বলেই ২০২৪-এ এসে বহু মানুষের জীবনের বিনিময়ে আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। তাহলে বিগত সময়ের আলোকে দেখা যাচ্ছে, শুধু আইন বা বিধি ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি বা রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়, সেই বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনী অত্যাবশ্যকীয় একটি অংশ। এর সংস্কার ছাড়া উদার, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। এখন সরকার থেকে পুলিশের কার্যক্রম কেমন হবে, পুলিশ কী কী করতে পারবে আর কী কী করতে পারবে না– এসব নিয়ম-নীতি সংস্কার করে দেওয়া হলো। আরও ঠিক করে দেওয়া হলো যে, পুলিশ তার নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারবে না, ঘুষ গ্রহণ করতে পারবে না, পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে দেওয়া হলো। এমন অনেক বিষয় পুলিশ বাহিনী পরিচালনার নিয়মনীতির মধ্যে যুক্ত করে দিয়ে এর সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলো। এখন তাহলে আমরা আশা করতে পারি যে, পুলিশ আর কখনও কোনো প্রকার অনিয়ম বা অপরাধ করবে না।
অন্যদিকে যদি নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের কথা বলি, তাহলেও কমিশনার নিয়োগের আইন থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি সব কিছু এমনভাবে সংস্কার করা হলো যে আর অনিয়ম করার সুযোগ থাকল না। তাহলে কি সর্বজন গ্রহণযোগ্য, প্রতিযোগিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে? এ ধরনের সংস্কারের ফলে কিন্তু একটা অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা এ ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি’র ওপর নির্ভর করতে হবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়ার জন্য। সেটি কেমন? এখানে একটু আলোচনা করা দরকার। প্রথমে কয়েকটি ‘যদি’ নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথম ‘যদি’ হচ্ছে যারা বা যিনি নির্বাচন কমিশনার বা পুলিশের বিভিন্ন পদে যুক্ত হবেন, প্রত্যেককে নিজের দায়িত্বের প্রতি যত্নবান এবং সৎ হবে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘যদি’ গণতান্ত্রিক চর্চা থাকে; ‘যদি’ সব দলের প্রার্থীরা অর্থ ও পেশি শক্তির ব্যবহার না করেন; ‘যদি’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে; ‘যদি’ প্রশাসনের সব স্তরের কর্মচারীরা চাকরি বিধি মেনে দায়িত্ব পালন করেন এবং সৎ থাকেন; ‘যদি’ বিচার বিভাগ সব দল ও মতের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে ও স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারে, ‘যদি’ সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও জনগণ দায়িত্ববান হন এবং ব্যক্তিজীবনে নীতি ও নৈতিকতা মেনে চলেন, তাহলে এ ধরনের সংস্কার তথা আইনকানুন ও বিধি-ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বির্নিমাণ সম্ভব হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো ‘যদি’র পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কি সম্ভব? আসল কথা হলো, এসব আইন, বিধিবিধান তো আর জনগণকে কোনো সেবা দিতে পারবে না।
এগুলো তো কিছু লিখিত কাগজ মাত্র। এসবের তো নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা নেই। মূলত এগুলো অনুসরণ করে জনগণকে সেবা দিয়ে থাকে মানুষ। সেই যোগ্য, নীতিবান, দায়িত্বশীল মানুষ তথা নাগরিক তৈরির উদ্যোগ কোথায়? যেখানে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য এমন কোনো কাজ নেই, যা সে করে না। যে সমাজে একজন নৈতিক ও মানবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন কাজ, সেখানে শুধু বিধি ব্যবস্থা ও আইনকানুনের সংস্কার করলে কি চলবে? এর সঙ্গে সঙ্গে যোগ্য নাগরিক তথা মানুষ তৈরির ব্যবস্থাও করতে হবে। যদি যোগ্য, দায়িত্ববান, নৈতিক ও মানবিক মানুষ তৈরির ব্যবস্থা রাষ্ট্রে নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে কোনো সংস্কারই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজে আসবে না– এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
শিশু একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ঠিকই কিন্তু সে বড় হয় সমাজে ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্য দিয়ে। মানবসন্তান প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এসব মানুষ তৈরির কারখানা তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। মানুষ তৈরির কারখানা সংস্কারে দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এখন পর্যন্ত যেসব কমিশন হয়েছে, সেগুলোর প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি যে সংস্কার কার্যক্রমের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি; সেই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তাহলে কি যে কারণে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বাংলাদেশ তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দেশ বির্নিমাণ সম্ভব হয়নি; সেই একই কারণে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশের স্বপ্ন কি স্বপ্নই থেকে যাবে এ জনপদের সাধারণ জনগণের?
মো. সাইফুজ্জামান: শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
shakdip@gmail.com