ইতিহাস
শেষ নেই মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের

ফাইল ছবি
রেজাউল করিম খান
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৫ | ০০:৩৯
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩ বছর পর এসে ফের যাচাই-বাছাই হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিতর্কমুক্ত, গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রণয়নই এর লক্ষ্য। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও স্বীকৃতি দেওয়ার বয়সসীমা পর্যালোচনাসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও নির্দেশিকা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার (পিতামহ/পিতা/মাতা ইত্যাদি) গেজেট যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’। এতে সারাদেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, অমুক্তিযোদ্ধারা স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে গেলে তারা সাধারণ ক্ষমাও পেতে পারেন। আর যদি না যান তো প্রতারণার দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা হবে। অভিযোগ আছে, মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে তালিকাভুক্ত ও গেজেটভুক্ত হয়ে সুবিধা গ্রহণ করছেন। এটি ছোটখাটো অপরাধ নয়, অনেক বড় অপরাধ। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাওয়া উচিত।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নানা ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। এটি এখন আবার হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ এবং যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তারাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যারা দেশ-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন যে অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০২২ সালে। সর্বশেষ সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধ করেছিলেন এবং যারা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, তাদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার বিষয় নিয়ে সরকার খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছে। প্রায় সবাই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আর যারা বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখেছেন, তারা একই কাতারে থাকতে পারেন না। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
খসড়া অধ্যাদেশে নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন; পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ রূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন। খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সহযোগীদের সম্পর্কে বলা আছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর মর্যাদা পাবেন।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বার বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে পাঁচবার। অধ্যাদেশ জারি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলাবে ১২ বার। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার। বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করা হলে স্বাভাবিকভাবেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে যাবে।
স্বাধীনতার পর কখনও কোনো বিধি মেনে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করা হয়নি। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে পাস করা কোনো আইনও নেই। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সব দলই মুক্তিযোদ্ধা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত। নিয়ম লঙ্ঘন করে আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। অথচ তারা কে কোন তালিকা থেকে এসেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। এর আগে যাচাই-বাছাইয়ের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এবং গেজেট করার সময়ে মন্ত্রণালয় ও জামুকার সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি অনিয়ম-দুর্নীতি বা ভুলত্রুটি কিছু হয়েই থাকে, তো সরকারি কর্মকর্তারা কেন দায়ী হবেন না– এ প্রশ্নের জবাব আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
একাত্তরে সমগ্র পূর্ব বাংলা ছিল শত্রুবেষ্টিত, অবরুদ্ধ। মানুষের জীবন ছিল কচুপাতার ওপর এক ফোঁটা পানির মতো। এমন অবস্থায় বাঙালি কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। তারা মনেপ্রাণে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এ দেশের নির্যাতিত জনগণ আশায় বুক বেঁধেছিল, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল তারা ভোগ করতে পারবে। শোষণ-বঞ্চনা চিরবিদায় নেবে। সাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। সর্বহারা থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে এবং মানুষের সব ধরনের মুক্তি সুনিশ্চিত হবে। কিন্তু অচিরেই জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তারা বুঝতে পারে, মানচিত্রগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শাসক আর শোষকের হাত বদল হয়েছে মাত্র। প্রকৃত স্বাধীনতা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে, বৈষম্য আর বঞ্চনার মাত্রা তত প্রকট হচ্ছে।
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বুর্জোয়া নেতৃত্বই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। ফলে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।
রেজাউল করিম খান: সাংবাদিক
rezaul.bd1956@gmail.com
- বিষয় :
- ইতিহাস