শৈশবের প্রিয় মুহূর্ত ছিল ভোরবেলায় ঢাকা থেকে আসা ভাই বা বোনের জন্য রেলস্টেশনে অপেক্ষা করা। প্ল্যাটফর্মের একদম কানায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে আসা ট্রেন ইঞ্জিনের অবয়বটি যখন দু’পাশের গাছের দেয়ালের ভেতর আবছা থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করত, সেটাই ছিল শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত। কেবল তাদের দেখা পাব বলেই নয়, তারা বই নিয়ে আসবেন বলেও। সুস্বাস্থ্যের ছিলাম না বলে শৈশবে খেলাধুলার চেয়ে বই নিয়ে পড়ে থাকাই উপভোগ করতাম বেশি। সুতরাং উভয় কারণেই সেটাই ছিল প্রিয় মুহূর্ত।

ছোরা হাতে পাঁচজন আমাকে ঘিরে ধরে। সঙ্গে টাকাপয়সা যা ছিল দিয়ে দিই। দ্রুতগতিতে তারা নিষ্ক্রান্ত হয়। তবে তাদের কারও কারও চেহারা আমার মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে।

পিকাসোর সঙ্গে এভাবে ছবি তোলা যায়। সময় এগিয়েছে, সুবিধা বেড়েছে। এমন ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব।

রাস্তায় বেরোলেই একটা ক্ষীণ, ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনতে পাই আমি। সে ফিসফিস করে বলে “এসব সত্য নয়! তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছো!”

সব সৃজনশীল মানুষ, তাদের শিল্পসাধনায় জীবনকে মাপতে চান। কবি বিনয় মজুমদার ছিলেন গণিত-সংশ্লিষ্ট মানুষ। তাই তিনি গণিতের সংখ্যা দিয়ে কবিতা নির্মাণে জীবন মাপতে চেয়েছিলেন। তবে সেটা গণিতের প্রচলিত নিয়মে নয়। তিনি জানতেন, গণিতের কোনো সংখ্যার ডান পাশে শূন্যের পর শূন্য বসালে সেটি হয়ে ওঠে একটি বড় সংখ্যা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনলেই ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো’ কিংবা ‘অবনী বাড়ি আছো’– এ রকম অসংখ্য পঙ্‌ক্তি যে কোনো বয়সী পাঠক সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করতে থাকেন। কোনো সংকোচ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত এই উচ্চারণ। যেন মুখের ভেতরে নয়, ঠোঁটের প্রান্তেই লেপ্টে থাকে এইসব হৃদয়-সঞ্চারী কবিতার চরণ।

কাইয়ুম চৌধুরী আমার শিক্ষক ছিলেন। আমার বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ছিলেন না যদিও। আমি ছিলাম পেইন্টিং বিভাগের ছাত্র, তিনি ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হওয়ার পরও। ছাত্র থাকাকালে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-শিক্ষক সহজাত দূরত্ববোধের জায়গা থেকে কিছু জড়তা কাজ করত, যা শিক্ষক হওয়ার পরও পুরোপুরি কখনও কাটেনি। কিন্তু সেই বাধা ডিঙিয়ে, স্যারের গুণে, অনেকটাই কাছে যেতে পেরেছিলাম।

কোনো এক ভোরবেলা সদ্য খোঁড়া টলটলে এক জলের অতলে মুখ ধুয়ে নিচ্ছেন কবি আবুল হাসান। ক্রমে ধূসর হয়ে আসা তাঁর দৃষ্টি সব স্মৃতি, সব বিস্মৃতি ভেদ করে হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো এক পৃথিবীর দিকে। হাসপাতালের বেডের পাশেই কি সেই অজানা পৃথিবীর সদ্য খোঁড়া অতল? এই ভূমির অজানা কেন্দ্রের দিকে নেমে গেছে কবেকার অবলুপ্ত সিঁড়ি? সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন কবি আবুল হাসান। নভেম্বর মাসের শীত গভীর মেঘের মতো বসে আছে তাঁর হাসপাতালের শেষ শয্যার শিয়রে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নির্দয় কাহিনিকার বাংলা সাহিত্যে খুব একটা নেই বোধহয়। তিনি নির্দয়, কারণ– তিনি ভালোবাসতে জানতেন। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে না পারলে সত্যিকার অর্থে নির্দয় হওয়া সম্ভব নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই সাহিত্যিকের নিরুপায় রূপে বিশ্বাস করতেন।