
একটি মানবশিশু জন্ম নিয়ে নিজের আগমন বা অস্তিত্ব জানান দেয় কান্না দিয়ে, হাত-পা নেড়ে, চক্ষু মেলে তাকিয়ে, শরীরের নড়াচড়া দিয়ে। এই কান্না-নড়াচড়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় শিশুটি সুস্থ-স্বাভাবিক হয়েছে। এতে নিকটাত্মীয়-পরিজন স্বস্তি লাভ করে আনন্দ পায়। এর পর পরিচর্যার মধ্য দিয়ে শিশুটি একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে। পিতামাতা নিকটজন শিশুটির হাত-পা, আঙুল, গাল, মুখ ছুঁয়ে, ধরে, নাড়াচাড়া করে খেলা করে আনন্দ পায়। বড়রা নানা ভঙ্গি করে আওয়াজ তুলে চেষ্টা করতে থাকে শিশুটিকে দিয়ে নিজেদের করা ভঙ্গি বা আওয়াজ করানোর জন্য। শিশুটি যদি একটু হাত-পা ছোড়ে, গালে টোল তুলে গুলুগুলু করে হেসে ওঠে, আঁ-ওঁ করে; তখন কী যে সুখ লাগে! আনন্দ পাওয়া যায়! অপরিসীম রোমাঞ্চকর এক অনুভূতির ভেতর দিয়ে লাভ করে পরম তৃপ্তি! কথা বলতে বা বুঝতে না পারা, সচেতন-বুদ্ধিহীন, অনুকরণপ্রবণ ওই শিশুটি তখন এক পুতুল যেন! বড়দের অঙ্গভঙ্গি আচরণ ইত্যাদির অনুকৃতিপ্রবণ ওই অবুঝ শিশুটি তো আমাদের খেলার আনন্দ দেওয়ার পুতুলমাত্র! শিশুর অসংলগ্ন হাত-পা ছোড়া, লালাভরা ঠোঁটের হাসি, বিচিত্র আঁ-ওঁ-এঁ ধ্বনি ইত্যাদি আমরা কত গভীরভাবে উপভোগ করি! সেই শিশু একটু বড় হলে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় বর্ণিল বিচিত্র রকমের মানুষ, জীবজন্তু, পাখি, নানা প্রাণী, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদির বিভিন্ন আদলের খেলনা, যা প্রকারান্তরে নানা রকমের পুতুল! শিশুকে হাসি-খুশি রাখা, আনন্দ দেওয়া, মুখে হাসি ফোটানো, কান্না থামানোর জন্য হাতে দেওয়া হয় কিংবা সামনে নড়াচড়া করানো হয় ওই 'পুতুল'।
পুতুল মানুষের চিরকালীন সঙ্গী। এমন জাতিগোষ্ঠী ধর্ম-বর্ণের মানুষ পাওয়া দুস্কর, যারা শিশুর হাতে পুতুল তুলে দেন না তাদের কান্না থামিয়ে মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। মানব সভ্যতার সমান বয়সী এই পুতুল হাত দ্বারা অথবা সুতা কিংবা কাঠির সাহায্যে নড়াচড়া করিয়ে বিনোদন ও লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মানুষ ব্যবহার করে আসছে; তার ইতিহাস-ঐতিহ্যও হাজার বছরের। ইতিহাস ও প্রামাণ্য দ্বারা স্বীকৃত, ভারতবর্ষ পুতুলনাট্যের আদিভূমি। মানব থিয়েটার প্রচলনের (খ্রি.পূ. ৪০০ বছর) প্রায় একশ বছর পূর্বে অর্থাৎ খ্রি.পূ. ৫০০ বছর আগে থেকে ভারতবর্ষে পুতুলনাট্য জনপ্রিয় ছিল বলে তাদের দাবি। ভারতবর্ষে পুতুলকে ঈশ্বরের 'অবুঝ' বা 'সন্তান' এবং পৃথিবীকে 'পুতুল-নৃত্য'র মোহ হিসেবে মনে করা হয়। তাই পুতুলনাট্যের কোনো পুতুল ব্যবহারের অনুপযোগী বা নষ্ট হয়ে গেলে তাকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সে নিজেদের আলয়ে অর্থাৎ স্বর্গে চলে বা ফিরে যেতে পারে। বাংলাদেশেও পুতুলনাট্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের- এ কথা ইতোমধ্যে প্রমাণিত গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে।
আমরা জেনেছি যে, মানুষ মৃত্যুভয়, অজানা আশঙ্কা ও অপশক্তি নিধনে বা প্রতিরোধের তাগিদে সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সৃষ্টি করেছে প্রাণীবাচক (টোটেম) বা কল্পনাসৃষ্ট (জাদু বা অলৌকিক) প্রতিরূপ, সদৃশ্য বা মূর্তি; অর্থাৎ পুতুল। ধীরে ধীরে পুতুল হয়ে ওঠে সামাজিক, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান (দেব-দেবী) ও লোকায়ত জীবনের অনিবার্য সামগ্রী (খেলনা প্রভৃতি)। এ অঞ্চলের মানুষ সাধারণভাবে ছোট ছোট মূর্তি বা প্রতিমূর্তিকে বলে পুতুল। এ ছাড়া মানবাকৃতি বা বৃহৎ আকারের ভারী শৈল্পিক প্রতিকৃতিকে বলে ভাস্কর্য (Sculpture)। মাটি, কাঠ, বাঁশ, কাপড়, তুলা, শোলা, কাগজ প্রভৃতিকৃত হাতে তৈরি নানা আকার-প্রকার ও রূপ-রঙের পুতুলের পসরা সাজিয়ে বসা গ্রামবাংলার বিবিধ মেলার অপরিহার্য ও চিরন্তন দৃশ্য। পুতুলের দোকানবিহীন কোনো লোকায়ত মেলা এই জনপদের মানুষের অকল্পনীয়। তালপাতা দিয়ে তৈরি পাখির আদল কিংবা দুটি বাঁশের কঞ্চির ফাঁকা স্থানে সুতা দ্বারা মানুষের ছায়ারূপ কাঠামো কিংবা মাটি দিয়ে তৈরি মাথা ও কাগজের ভাঁজ করা ফণাসমেত সাপ মাটির চাকার সঙ্গে সুতা বেঁধে চালানো প্রভৃতি লোকায়ত খেলনা পুতুলকে বলা যায় পুতুলনাট্যের পুতুলেরই শিথিল রূপ। এ ছাড়া কৃষিজীবী মানুষ বন্য পশু-পাখি ইত্যাদির আক্রমণ থেকে ক্ষেতের ফসল রক্ষা করার নিমিত্তে 'ক্রস' বাঁশে খড় বেঁধে শীর্ষে মাটির হাঁড়িতে কালি মেখে চুন দিয়ে মানুষের চোখ-মুখ-নাকের রেখা অঙ্কিত করে খড়-বাঁশের কাঠামোয় পুরোনো শার্ট পরিয়ে যে 'কাকতাড়ূয়া' জমিতে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং কাকতাড়ূয়ার হাতে টিন ঝুলিয়ে তার সঙ্গে দড়ি লাগিয়ে দূর থেকে নাড়ানো হয়, আওয়াজ তৈরি করা হয় পাখিকে ভয় পাওয়ানোর জন্য; তা তো এক প্রকার পুতুল চালানোই। এখানেও দৃষ্ট হয় পুতুলনাট্যের পুতুলের লোকায়ত ঢলঢল রূপ।
প্রাচীনকাল থেকেই পুতুলনাট্য সর্বশ্রেণির দর্শকের আনন্দ বিনোদনের শিল্পসঙ্গী। কৃত্য এবং মানুষের শিল্পরস আস্বাদন ও আনন্দদানের শিল্পমাধ্যম রূপে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পুতুলনাট্যের প্রসার ঘটেছে। দেখা গেছে, এই ভূখণ্ডে একদা বিনোদন ছাড়াও ধর্মীয় ও লোকশিক্ষার অন্যতম জনপ্রিয় মধ্যম ছিল পুতুল নাটক। নানা মুনির নানা রচনায় প্রচুর প্রাসঙ্গিক তথ্য মিলেছে পুতুলনাট্য অভিনয় এবং এর নানা কীর্তি সম্পর্কে। বাংলাদেশে অর্থাৎ বাংলাভাষী অঞ্চলে কবে থেকে পুতুলনাট্যের যাত্রা শুরু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য অদ্যাবধি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিভিন্ন গ্রন্থ, বর্ণনা কিংবা স্মৃতিচারণ থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের আলোকে এ দেশের পুতুলনাট্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায় মাত্র। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ভারতবর্ষই পুতুলনাটকের 'আদিভূমি'। তাদের মতে, মানব থিয়েটার প্রচলনের (খ্রি.পূ. ৪০০ বছর) প্রায় একশ বছর পূর্বে অর্থাৎ খ্রি.পূ. ৫০০ বছর আগে থেকে ভারতবর্ষে পুতুলনাটক জনপ্রিয় ছিল। গবেষকদের ধারণা, প্রাচীন লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের আদি নৃগোষ্ঠীর শস্য ও ধর্মীয় আনন্দ-নৃত্য উৎসবে ব্যবহূত 'নড়নক্ষম' দেহবিশিষ্ট মুখোশগুলোর মধ্যেই নিহিত ছিল পরবর্তীকালের পুতুলনাট্যের 'পুতুল' বা 'পাপেট' (puppet)-এর 'অঙ্কুর'। মধ্যযুগের প্রায় সব প্রধান কবির রচনায় 'পুতুল' কিংবা 'পুতুলবাজি' বা 'পুতুলনাচ'-এর উল্লেখ দৃষ্ট হয়। পণ্ডিতদের অভিমত, সমকালে পুতুল ও পুতুলনাট্যের ব্যাপক প্রচলন ছিল বিধায় তৎকালে রচিত বিবিধ রচনায় এসব প্রসঙ্গ বিদ্যমান। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে (খ্রি.পূ. ৮ম-১১শ) ধৃত জীবন ও জীবিকার চিত্র একান্তই বাংলার এবং বাঙালির। এতে নানাবিধ সংগীত, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি এবং 'বুদ্ধনাটক' অভিনীত হওয়ার তথ্য দৃষ্ট হয়। এ থেকে প্রতীয়মান, সে সময়ে নট-নটীসহ বিভিন্ন অভিনয়ের প্রচলন ছিল। পুতুল বা পুতুলনাট্যের প্রত্যক্ষ কোনো উল্লেখ পাওয়া না গেলেও চর্যাপদকারদের প্রাপ্ত বিভিন্ন ভঙ্গিমার রেখাচিত্র এবং পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে স্ত্রী-পুরুষ, জন্তু, পাখি, দেবতা, ফুল-লতাপাতা, নর্তক-যোদ্ধা-কিন্নরী, খেলনা নৌকা, আলিঙ্গনাবদ্ধ নারী, মুখোশ, খেলার ঘুঁটি ইত্যাদির চলন ভঙ্গিমার চিত্র দৃষ্টে অনুমান, চর্যার কালেও পুতুল বা পুতুলনাট্যের অস্তিত্ব ছিল। লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দ (১২ শতক) প্রাচীন বাঙলা-নাট্যরীতির একটি নৃত্য সংবলিত 'গীতিনাট্য'। কাব্যের মূল বিষয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। কোনো কোনো গবেষক অনুমান করেছেন, উক্ত গীতিনাট্যের 'রাধা ও কৃষ্ণ- এ দুই ভূমিকা পুতুলের দ্বারা প্রদর্শিত' হতো। কিন্তু সমগ্র নাট্য পরিবেশনায় মাত্র দুটি চরিত্রের অভিনয় পুতুল দ্বারা দেখানো হতো; এরূপ মত গ্রহণযোগ্য নয়। বরং পুতুলের দ্বারা পুরো কাব্য অভিনীত হতো বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অপর নাট্য বিশেষজ্ঞ। গবেষক বড়ূচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৪-১৫ শতক)-কে বলেছেন 'পুতুলবাজি সহযোগে কৃষ্ণকাহিনী পদগীতির বই' বা 'পাঞ্চালিকা নাট্য অর্থাৎ 'পুতুলনাচ'। অবশ্য এটি 'শুধু পুতুলনাচের জন্য' রচিত হয়েছিল বলে তর্ক থাকলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যে গায়েন-দোহার ও পাত্রপাত্রী সহযোগে অভিনীত হওয়ার পাশাপাশি পুতুল দ্বারাও যে অভিনয় ও জনপ্রিয় ছিল- সে ধারণা বলা যায় সন্দেহাতীত। পরের-ষোল শতকের রামায়ণ, মহাভারতসহ বাঙলা 'প্রণয়মূলক পাঁচালি' ধারায় রচিত কাব্যসমূহ ছিল আসরের সামগ্রী। আসরে আসরে যেমন সংগীত-নৃত্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা হতো, পাশাপাশি সেগুলো পুতুলের অভিনয় দ্বারাও ব্যাপক অভিনীত হওয়ার প্রামাণ্য উল্লেখ পাওয়া যায় নানা মুনির নানা রচনা বা উক্তি-স্মৃতিভাষ্যে। বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই জনপদে বিনোদন ও লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং সমৃদ্ধ ছিল পুতুলনাট্য।
বলা হয়ে থাকে, পুতুলনাট্যও মানব থিয়েটারের মতো 'সিম্প্যাথেটিক জাদু' (Sympathetic Magic) থেকে উদ্ভূত। আর তাই নানা রকমের পুতুলনাট্য যেমন রয়েছে, তেমনি আছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব শিল্প-বৈশিষ্ট্য এবং নির্দিষ্ট কিছু নাট্যিক উপাদান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা ঐতিহ্যগত কারণ দ্বারা পুষ্ট হয়ে স্বতন্ত্র রীতি বা ধারার পরিচিতি অর্জন করেছে প্রতিটি পুতুলনাট্য-আঙ্গিক। অবশ্য একাধিক ধারা বা বৈশিষ্ট্যের পুতুলনাট্যরীতি দৃষ্ট হয় অভিন্ন ভৌগোলিক পরিকাঠামোর ভেতরেও। এ অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় বাংলাদেশেও সৃজিত হয়েছিল নানা রকমের পুতুলনাট্য। বিশ্বের নানাদেশে প্রচলিত ১৫-২০ ধরনের পুতুলনাট্যের সন্ধান পেলেও আমরা জানি, বাংলাদেশে সাকল্যে তিন অথবা চার শ্রেণির পুতুলনাট্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ঐতিহ্যবাহী ধারায় বর্তমানে কেবল সুতা পুতুলনাট্যের (String Puppetry) অস্তিত্ব লভ্য। এ ছাড়া সীমিত আকারে আধুনিক 'পাপেট নাট্যকলা' রূপে অল্প-বিস্তর বিস্তার লাভ করেছে 'দণ্ড' বা 'রড' এবং হস্তচালিত পুতুলনাট্য। কিছু ক্ষেত্রে আঙুলচালিত পুতুলনাট্য ও মাপেট (Muppet) প্রয়োগও দৃষ্ট। গবেষকের মতে, পুতুলনাট্য হলো 'বস্তুজাত ও বাকজাত' দ্বারা গঠিত 'মিশ্র লোক-শিল্পকলা'। কেননা, এতে মাটি, কাঠ, শোলা (উলুখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ), তুলা, কাগজ, কাগজের মণ্ড, কাপড়, থার্মকল, ফোম, অলংকার, পোশাক প্রভৃতি 'বস্তুজাত' উপকরণ এবং পুরাণ, লোকায়ত গল্প, কাব্য প্রভৃতি 'বাকজাত' সাহিত্য-উপাদান; বাকসৃষ্ট অভিনয় (কণ্ঠ) ও গীত সহযোগে পরিবেশিত হয়। সাধারণত পুতুলনাট্যকে শ্রেণিকরণ করা হয় অভিনেয় পুতুল সঞ্চালন বা পরিচালনা কৌশল অবলম্বনের ভিত্তিতে।
ছোট আকারের প্রসেনিয়াম আদলে তৈরি মঞ্চের নেপথ্য থেকে কিছুটা উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে পেছন-পর্দার ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে (হাত যেন দর্শক দেখতে না পায়) সুতায় ঝুলানো পুতুল সঞ্চালনপূর্বক অভিনয় উপস্থাপন করা হয় সুতা-পুতুলনাট্যে। ভারতের কোথাও কোথাও একে বলা হয় 'তারের পুতুলনাচ'। পাশ্চাত্যে বলা হয় 'ম্যারিওনেট' (Marionette)। অনেক গবেষকের অভিমত, সুতা-পুতুলনাট্যই অন্যান্য ধারা পুতুলনাট্য অপেক্ষা প্রাচীন। তাদের মতে, প্রাচীন মিসর ও গ্রিসে পুতুলনাট্যের যে নিদর্শনের সন্ধান মিলেছে, তা ছিল মূলত সুতায় টানা পুতুল। জার্মানি, রাশিয়া, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় ঐতিহ্যের হাত ধরে সুতা পুতুলনাট্য বর্তমানে একটি সমৃদ্ধ, উচ্চ-শিল্প মানসম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক শিল্পকলা রূপে উৎকর্ষ লাভ করেছে। ভারতসহ প্রাচ্যের অনেক দেশ ইতোমধ্যে সুতা-পুতুলনাট্যে অর্জন করেছে খ্যাতি। উল্লেখ্য, ভারতের রাজস্থানের 'ভাট' (ভট<সং-ভৃত) বা চারণ সম্প্র্রদায়ের বংশানুক্রমে 'কাঠপুতলি' নামাঙ্কৃত সুতা পুতুলনাট্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বিশ্বখ্যাত। গবেষকদের মতে, 'কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে' থেকে ভারতে 'সূত্রপুতুল' সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পুরোনো পুতুলনাট্য আঙ্গিক। অষ্টম শতকে এবং তারও পূর্ব থেকে এ দেশে সুতায় বাঁধা পুতুল দ্বারা রাধা-কৃষ্ণের লীলা বিষয়ক আখ্যানসহ এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, বিশ্বাস আচার-সংস্কার বিষয়ক নানা গল্প-কাহিনি সুতা দ্বারা পুতুল নাচিয়ে অভিনয় উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পুতুল নাচিয়েকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে 'সূত্রধর' (Sutradhar), অর্থাৎ 'সুতা-ধারক' (String-Holder) বা 'সুতা-চালক' (String Puller) বলা হয়।
পুতুলনাট্যকে বলা হয় 'সাধারণ সহজ থিয়েটার'। একই সঙ্গে তা 'যুগোত্তর উত্তরাধিকারে সনাতন, ঐতিহ্যময় এবং বিজ্ঞান ভাবনার সম্ভাবনায় টইটম্বুর আধুনিক।' কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত পুতুলনাট্য সম্পর্কে উপর্যুক্ত অভিমত যথার্থ নয়। হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী এই শিল্পকলা এবং এর সঙ্গেকার মানুষ 'চোখের আলোয়' থেকেও থেকে গেছে 'চোখের বাইরে'। মানুষ যখন শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আর পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে তৎপর, উদ্বিগ্ন; সে সময় অবজ্ঞা, অবহেলা আর উন্নাসিকতার বলি হয়ে এই প্রাচীন শিল্প ও এর সঙ্গে থাকা মানুষ অসহায় অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। পুতুলনাট্য পেশায় থেকেও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে এ পেশা থেকে বেরিয়ে যেতে। মাঠ পর্যায়ের তথ্যানুসন্ধানে এমন কম মানুষই পাওয়া গেছে যারা পুতুলনাট্যকে পেশারূপে টিকিয়ে রাখতে কিংবা নিজের সন্তান বা নিকটজনকে এ শিল্পে যুক্ত করতে চান। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে পুতুলনাট্যের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে কালো অধ্যায়ের সূত্রপাত; তার শিকার অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্প আঙ্গিকের মতো পুতুলনাট্যও। তদুপরি প্রান্তিক পর্যায়ে অনুসন্ধানপূর্বক সন্ধান মিলেছে অন্তত পঞ্চাশটি পুতুলনাট্য সংগঠনের। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে সক্রিয় আছে মাত্র ১২ থেকে ১৫টি। তারা প্রায় সবাই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অতি পুরোনো জীর্ণ পুতুল দিয়ে কিছু খণ্ড কথাবার্তা, হাস্যকৌতুক-নকশা, সিনেমার গান ইত্যাদি পরিবেশন করে এবং তাদের এসব পরিবেশনা অনিয়মিত; শুধু মেলাকেন্দ্রিক। ঐতিহ্যবাহী ধারার পুতুলনাট্যকে টিকিয়ে রাখা এবং একে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করে এই শিল্প আঙ্গিকের অমিত শক্তিকে সম্ভাবনার নানাবিধ কাজে ব্যবহারে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি এ শিল্পের মুখ্য সমস্যাগুলো। শিল্পী ও দলের অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের সমস্যাবলি ছাড়াও বেশকিছু ত্রুটি বা ঘাটতি রয়েছে, যা এ শিল্পের সৌন্দর্য ও নান্দনিক মূল্যমানকে ব্যাহত করে প্রবলভাবে।
সব পর্যায়ে আমাদের মনে হয়েছে, এ দেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য পুরোনো দিনের পুনরাবৃত্তিসম্পন্ন অতিক্লিষ্ট একটি শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। একদা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন অনুসন্ধিৎসার স্থল থেকে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের পুতুলনাচের দলগুলো বর্তমানকালের যাত্রা ও চলচ্চিত্রের মুখোমুখি অনেক কষ্টে টিকে আছে এবং টিকে থাকার পন্থাটি শিল্পরুচিসম্পন্ন নয় আদৌ।' তিনি আরও বলেছিলেন, 'আধুনিক জীবন থেকে চরিত্র ও কাহিনি গ্রহণ ব্যতিরেকে এই শিল্প মাধ্যমকে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। উপরন্তু পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে আধুনিক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত না করলেও পুতুলনাচের পক্ষে আধুনিককালে যান্ত্রিক গণমাধ্যমের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল হবে।' (ভূমিকা, বিশুকুমারের পুতুলনাচ; নান্দীপাঠ, ১ বর্ষ ২ সংখ্যা, জুলাই ১৯৮৮)।
আমাদেরও মনে হয়েছে, অপার সম্ভাবনাময় এবং অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অমোঘ শক্তিসম্পন্ন এই শিল্পমাধ্যমকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়; একে বাঁচিয়ে তুলে, পুষ্টি দিয়ে সমৃদ্ধ করে তোলা এখন সময়ের দাবি। আমরা জানি, পুতুলনাট্য এখন কেবল শিশু-কিশোর কিংবা পশ্চাৎপদ, অক্ষরজ্ঞানহীন জনগোষ্ঠীর বিনোদন বা লৌকিক শিক্ষার মাধ্যম মাত্র নয়। এই শিল্পমাধ্যম আধুনিককালে শিক্ষা বিশেষ করে শিশু-শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, তথ্য-প্রচার, গণসচেতনতা, বিজ্ঞাপন, পরিবেশ-উন্নয়ন, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়ন, মনোচিকিৎসা, প্রতিবন্ধী শিশুর বিকাশ, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন প্রভৃতিতে ব্যবহার করার জন্য একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে নানা দেশে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই শিল্পের ব্যাপক প্রয়োগ ও প্রসার অত্যন্ত জরুরি।
লেখক
শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক
মন্তব্য করুন