
বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য অংশ পহেলা বৈশাখ। একে শুধু বর্ষবরণ বললে মূল্যায়ন শেষ হয় না। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-কৃষ্টি, চেতনাসহ অনেক কিছু। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণ করা হয় বলে আমাদেরও সেটা মানতে হয়। এটা বস্তবতা। কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্ন যখন আসে তখন নিজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চেতনার দিকে তাকাতেই হয়। আমরা যতই ইংরেজি বলি; কখনোই ইংরেজ হতে পারব না। আরবের আদব-কায়দা, ভাষা শিখলেই কেউ আমাকে আরব বলে গ্রহণ করবে না। একইভাবে ফরাসি, পর্তুগিজ, মঙ্গলীয় কিংবা কেনিয়ার ম' ম' সম্প্রদায়ের কথাও যদি বলি; প্রত্যেকেরই আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, কৃষি পদ্ধতি রয়েছে। আমি চাইলেই তাদের একজন হয়ে উঠতে পারব না। আমাকে সেভাবে গণ্যও করা হবে না।
আমরা বাংলাভাষী। বাংলা ভূখণ্ডের নিজস্ব সংস্কৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখানে বিশেষ কোনো একটি রীতি-নীতি, চেতনা সেভাবে গুনতিতে আসে না। সবাই মিলে আমরা বাঙালি। সারাবছর ধরে বাংলা সংস্কৃতির মধ্যেই আমরা থাকি।
শহুরে জীবনযাপন, চাল-চলন দিয়ে কিন্তু এটাকে বিবেচনা করা যাবে না। আমাদের সংস্কৃতির শিকড় সন্ধান করতে গেলে গ্রামে যেতে হবে। গ্রামের মানুষ কেমনভাবে চলে সেদিকে যদি তাকাই, সেখানে বাঙালিত্ব খুঁজে পাব। তারা তাদের কাজ, জীবনাচার, উৎসব, আয়োজনের মধ্যে বাঙালিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় প্রকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিদ্যমান।
শৈশবের দিকে যদি তাকাই- ব্রিটিশরা যখন যাই যাই করছে, সেই সময় আমার জন্ম। অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান। এত অল্প বয়সের স্মৃতি আমার সেভাবে মনে পড়ে না। কিন্তু '৪৭-পরবর্তী সময়টা বেশ মনে আছে। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার সময় যেটা লক্ষ্য করেছি; পশ্চিম পাকিস্তানিরা সব সময় চেষ্টা করেছে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ওদের সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান সঞ্চারিত করতে। আমাদের বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা ছাড়াও বিভিন্ন রকম দমন-পীড়নে বাঙালিদের দমিয়ে রেখে; উর্দু, পাঞ্জাবি বা অন্য কোনো পশ্চিম পাকিস্তানিভাষীদের পক্ষপাত আমরা হরহামেশা দেখেছি। এত কিছু ভোগান্তির মধ্যেও বাঙালি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যায়নি কিংবা হার মানেনি।
ভাষা আন্দোলন দিয়েই যদি বিষয়টা আমরা বোঝার চেষ্টা করি, দেখব; বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যারা কাজ করছিল তাদের প্রতিহত করা, পূর্ববাংলা বা পশ্চিম পাকিস্তানের যারা নেতৃত্বে ছিল তাদের প্রতিহত করার জন্য বাঙালি আন্দোলন করেছে; রক্ত দিয়েছে। পাকিস্তানিরা বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু দমাতে পারেনি। বিগত শতকের ষাটের দশকে আইয়ুব খানের আমলে রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে বাঙালি সংস্কৃতিকে খর্ব করে পশ্চিম পাকিস্তানি সংস্কৃতিকে প্রোথিত করার ষড়যন্ত্র ও চেষ্টা তারা করেছে। বাঙালি তা প্রতিহত করেছে। ফলে তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। যত তারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, ততই আমাদের আন্দোলন জোরদার হয়েছে। আমরা বেশ বুঝতে পারতাম, এদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। এ জন্য সে সময় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙলি নিজ অবস্থান থেকে সরেনি। পশ্চিমারা যেন আমাদের না সরাতে পারে, সে জন্য বাঙালি সব সময় আন্দোলনে ছিল। এই সময় ছায়ানটের আন্দোলন, রমনায় পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ ছিল বিশাল ঘটনা। এ আন্দোলন পুরো ষাটের দশকে চলেছে। সেখানে '৬৯-এর গণজাগরণের কথা যদি বলি সেটা ছিল এই একই আন্দোলনের স্রোতধারা। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছি। আর সেই চেষ্টা থেকেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা। আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। পহেলা বৈশাখ এখনও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিরন্তর প্রেরণা। আমরা ভুলে যাইনি পাকিস্তান আমলে আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের দিনগুলি। সেই চেতনায় আমরা এগিয়ে যেতে চাই। এখন উৎসবের বিস্তৃতি ঘটেছে আরও বেশি করে। চারদিকে বেশ ঘটা করে বর্ষবরণ উদযাপিত হতে দেখি। রাজধানীতে রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণে মানুষের ঢল দেখি। এ ছাড়াও আগারগাঁও, কলাবাগান, বনানী, গুলশান, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা বর্ষবরণ উৎসব দেখি হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে। আমরা চারুকলা থেকে যখন মঙ্গল শোভাযাত্রা করি; হাজার হাজার মানুষ কিন্তু সেই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। জনপ্রিয় এই শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর স্বীকৃতির [ইনটেনজিবল হেরিটেজ] মাধ্যমে আন্তর্জতিকতা পেয়েছে। আমরা কিন্তু কাউকেই বলি না, অমুক তারিখে শোভাযাত্রা হবে; তোমরা আসো। নিজেদের মধ্যে থাকা বাঙালি অনুভূতি, চেতনাবোধ থেকেই তারা চলে আসে।
এর সঙ্গে মন খারাপ করা বিপরীত একটা দিকও আছে। পাকিস্তান আমলে যেটা হয়নি; স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা হয়েছে। বাঙালিত্বের পরিচয়বাহী অসাম্প্রদায়িক এ উৎসব বন্ধ করার অভিসন্ধিতে রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছিল। বহু মানুষ সেদিন প্রাণ দিয়েছে। তবু থেমে থাকেনি উৎসব। ভিন্ন স্রোত যে থেমে নেই- তা আমাদের পারিপার্শ্বিকতাই বলে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সবকিছুতে লোক দেখানোর প্রবণতা। সেটা চেতনা বা বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন। আমরা বুঝে বা না বুঝে, অন্য কারও দুরভিসন্ধিতে প্রভাবিত হয়ে যাপনের চাইতে প্রদর্শনের বিষয়কে মুখ্য করে তুলছি। ট্রেন্ডে না থাকলে যেন চলছেই না। এই ধারাতে আমাদের পোশাক-আশাকেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দৈনন্দিন জীবনের পোশাকে আরবীয় সংস্কৃতি ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন মনে হয়, এটা যেন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা। আজকাল বিদেশ গেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়- এরা হয় পাকিস্তানি, নয় বাংলাদেশি, যা বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করে না। এটা এক বিশাল পরিবর্তন। আগে কিন্তু এমনটা ছিল না। শাড়িই বেশি পরতে দেখতাম। পাকিস্তান হওয়ার পর সালোয়ার-কামিজ কিছু এসেছে। কিন্তু এখন বাঙালি পোশাকের ঐতিহ্যই যেন হারিয়ে গেছে। আমার তো শঙ্কা হয়- শাড়ি বলে যে বাঙালি নারীর একটা পোশাক ছিল; সেটা বোধ হয় হারিয়েই যাবে। আমাদের দেশের পায়জামা-পাঞ্জাবিরও কিন্তু বিশেষত্ব আছে। মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানিদের মতো নয়। তারও পরিবর্তন এসেছে। ধর্ম বা বিশ্বাস বা চেতনায় আস্থা বা সমর্পণ বড় কথা নয়। বরং বিশেষ ওই পোশাক না পরলে নিজেকে বিশেষ বিশ্বাসে বিশ্বাসি বলে উপস্থাপন করা যাবে না- এটাই বড় হয়ে উঠছে।
ঘটা করে পহেলা বৈশাখে অন্তত সবাই চেষ্টা করে শাড়ি পরতে। আমরাও শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা যেন ওই বিশেষ দিনের জন্য। এই লোক দেখানো পোশাক পরাও অন্তত আমার পছন্দ নয়। এখানে একটা প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়- বাঙালির নিজস্ব পরিচয় কি হারিয়ে যাচ্ছে?
এই যে পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি, বসন্তবরণ, নবান্ন, হালখাতা উৎসব; এগুলো আমাদের একান্ত আপন। এসব উৎসব আমাদের ঋতুর সঙ্গে জড়িত। আমাদের ঐতিহ্য ঋতুকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। ইউরোপ বা আমেরিকায় চার ঋতু। আমাদের সেখানে ছয় ঋতু। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর বিষয়টা এই ভূখণ্ডের নিজস্ব। পুরো উপমহাদেশেই এটা আছে এবং সবাই উদযাপন করে। পহেলা বৈশাখও হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই উদযাপন করে। এই উৎসব বিশেষ কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নয়। এটা একেবারেই আমাদের নিজস্ব একটা বিষয়; বাঙালিত্বের বা বাঙালি জাতির বিশেষ একটা দিন। আমার আহ্বান থাকবে- নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই অসাম্প্রদায়িক এ উৎসবের চেতনাকে সবাই ধারণ করি। আমরা আমাদের নিজস্বতা নিয়েই উৎসবে মেতে উঠি।
লেখক
চিত্রশিল্পী
মন্তব্য করুন