ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

সাক্ষাৎকার: ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

সংসদে বিরোধী কণ্ঠ নেই, একদলীয় হয়ে গেছে

সংসদে বিরোধী কণ্ঠ নেই, একদলীয় হয়ে গেছে

রুমিন ফারহানা

লোটন একরাম

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ০২:১৬

সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবির দায়বদ্ধতা থেকে নিজেরাই আগে পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন সদ্য পদত্যাগী হুইপ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যুগপৎ আন্দোলনের দাবি হিসেবে বিএনপি ১০ দফা দিয়েছে। সেখানে প্রথম দফায় সংসদ ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সেই দাবিকে বাস্তবায়ন করতে বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, সংসদে এখন আর বিরোধী কণ্ঠ নেই। কার্যত সংসদ একদলীয় হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে আমাদের পদত্যাগে চাপের মুখে পড়েছে সরকার।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার ল্যাবরেটরি রোডের বাসভবনে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এক দিন আগে পদত্যাগী সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা এসব কথা বলেন। বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এবং দলের মিডিয়া সেল ও ফরেন উইংয়ের সদস্যও তিনি।

সমকাল : আপনারা কারচুপি এবং নিশিরাতের ভোট বলে নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করলেন, পরে আবার শপথ নিয়ে সংসদের মেয়াদ পূর্তির এক বছর আগেই পদত্যাগের কারণ কী?

রুমিন ফারহানা :দেখুন, আমরা যখন সংসদে যাই তখন বলেছিলাম- কৌশলগত সিদ্ধান্ত থেকে সংসদে যাচ্ছি। আমাদের কথা বলার জায়গা খুবই সংকুচিত ছিল। কথা বলতে দিচ্ছিল না। প্রেস ক্লাবের মিটিংগুলোও অনুমতির বেড়াজালে আটকা ছিল। দেশ ও মানুষের পক্ষে সংসদে কথা বলার একটা প্ল্যাটফর্ম মনে করেছিলাম। সেখান সংসদে যুক্ত হওয়া, একটি বা দুটি ছাড়া সংসদে আর বিরোধী কোনো কণ্ঠ শোনা যায় না। সরকারি দলও বলছে, বিরোধী দল বলতে এখন বিএনপির গুটিকয়েক সদস্য। সার্বিক বিবেচনায় আমরাই ছিলাম বিরোধী দল। সে অনুযায়ী কথা বলার সুযোগ ছিল না। জাতীয় পার্টি নিজেকে বিরোধী দল মনেও করে না, সরকারের অনুমতিতে সংসদে গেছে। আমরা কথা বলতে গেলে মাইক বন্ধ করে দিয়েছে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গিয়েছিলাম এবং কয়েক বছর জনগণের পক্ষে সংসদে কথা বলেছি। তাই দলের দাবির পক্ষে সমাবেশে জনগণকে সাক্ষী রেখেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি।

সমকাল : আপনাদের পদত্যাগপত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কী লেখা হয়েছে?

রুমিন ফারহানা :ভোটারবিহীন সরকারের গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট আচরণ, বাকস্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে যথেষ্ট সুযোগ না দেওয়া, কার্যত সংসদকে অকার্যকর করে রাখাসহ সব অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদেই আমরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছি।

সমকাল :সাক্ষাৎকালে আপনাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তে স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী কী বললেন?

রুমিন ফারহানা : অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তাঁর নেতৃত্বে কাজ করেছি। শেষ বেলায়ও সে পরিবেশ বজায় ছিল। তিনি বললেন, কেন পদত্যাগ করছেন বুঝতে পারছি না, হঠাৎ কী হলো? এখানে তো আমার কিছু বলার নেই বলে জানালেন।
সমকাল : আপনারা কি মনে করেন এ পদত্যাগের সিদ্ধান্তে দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন করে সরকার চাপের মুখে পড়বে?

রুমিন ফারহানা : ইতোমধ্যে সরকার চাপের মুখে পড়েছে বলে আমরা মনে করি। সংসদে এখন আর বিরোধী কণ্ঠ নেই। কার্যত সংসদ একদলীয় হয়ে গেছে। জাপা বিরোধী দলের অভিনয় করেছে। ৩৪৩ জন বসে আছেন- একজনও ভোটে জিতে আসেননি। রাশেদ খান মেনন, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, রাতের ভোটে তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন- সেখানে আমার আর কী বলার আছে।

সমকাল :আপনাদের পদত্যাগকে গুরুত্ব দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ৩৫০ আসনের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ আওয়ামী লীগের। কাজেই এতে সংসদের বা সরকারের পতন বা কিছু যায় আসে না বলে জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

রুমিন ফারহানা : এ কথাটি বলে ফেলা- তার মানেই গুরুত্ব দিচ্ছে। 'কেয়ারফুলি কেয়ারলেস' বলে একটা কথা আছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক 'কেয়ারফুলি কেয়ারলেস' হওয়ার অভিনয় করছেন। তিনিও খুব ভালো জানেন সংসদটা একেবারে বিরোধী দলবিহীন হয়ে গেছে। সংসদে এখন আর সমালোচনা, সরকারের কোনো ভুল নিয়ে আলাপ হবে না। মানুষ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলছেন, সংসদ আর দেখা যাবে না। এটা এখন স্তুতিস্তাবকে ভরা একটি জায়গা হয়ে গেছে।

সমকাল :আবার আপনাদের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ পথে হাঁটবে না?

রুমিন ফারহানা :আমরা তো দলগতভাবে কোনো আহ্বান জানাইনি। মহাজোটের সঙ্গী হয়ে ২০০৮ সালে তারা ক্ষমতায় এসেছে। স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। সব সময় দুটি স্বৈরাচারের সম্পর্ক মধুর হবে, এটাই স্বাভাবিক।

সমকাল :রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আপনাদের এই সিদ্ধান্ত ভুল ও বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলেন?

রুমিন ফারহানা :একই প্রশ্ন আলজাজিরাও করেছিল। সেখানে আমি পরিস্কার বলেছি, প্ল্যাটফর্ম একটি না, এখন অনেক আছে। আমরা সভা-সমাবেশ করছি। আন্তর্জাতিক চাপে হোক ও দেশি চাপে হোক- সরকার অনুমতি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আমি প্রতিদিন কোনো না কোনো টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে কথা বলছি। প্ল্যাটফর্ম করতে চাইলে এখন অভাব হবে বলে বিশ্বাস করি না। কতটা ব্যবহার করতে পারব সঠিকভাবে, সেটা এখন বাড়তি চ্যালেঞ্জ।

সমকাল :পর্যবেক্ষকরা এও বলছেন, এতে বিএনপির আন্দোলনে খুব একটা উপকার আসবে না। এমনকি দাবি আদায়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ অথবা সংসদের কার্যক্রমে খুব একটা ব্যাঘাত ঘটবে না বলে মনে হয় না। আপনাদের যুক্তি কী?

রুমিন ফারহানা :এটা সময়ই বলবে। তবে আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, এই সংসদ একেবারে একদলীয় সংসদ। এখান থেকে জাতি কিছু পাবে বলে মনে করে না। এতদিন সংসদে দু-একটি জোরালো সমালোচনা করত, আইনের ব্যাপারে কথা হতো, মন্ত্রীদের প্রশ্ন করা হতো, জবাবদিহির মধ্যে আনার চেষ্টা করত- সেটা আর হবে না।

সমকাল :যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে সমমনা দল হিসেবে জামায়াত ছিল না। প্রকাশ্যে তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ করা হয়নি। অথচ ১০ ডিসেম্বর জামায়াতও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি দিয়েছে। এটি কীসের ইঙ্গিত?

রুমিন ফারহানা :দেখুন, স্বৈরাচাররা কিছু বয়ান তৈরি করে রাখে। এই বয়ানের ওপর তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধী, অগ্নিসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ- এগুলো এখন আর মানুষ বিশ্বাস করে না। এখন যদি সরকারের সঙ্গে থাকেন, তার সব অপকর্মের দোসর হন, একাত্তরে ভূমিকা যাই হোক কেন- আপনি মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক হবেন। মানুষ তাদের বয়ান প্রত্যাখ্যান করেছে। মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারাই এসব ইস্যুতে আন্দোলন করবে, আমরা তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করব। এখন এসব হিসাব করার সময় নয়। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়ে গেছে। এখন জামায়াতের সবাই নতুন প্রজন্ম।

সমকাল :ঘোষিত দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অথচ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আন্দোলন করে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার?

রুমিন ফারহানা :সফলতার ব্যাপারে আমি ১০০ ভাগ আশাবাদী। ওই সব আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলে বিশ্বাস করি না। একটা দল কতটা নির্মম হতে পারে, বিরোধী দল দমন-পীড়নে। যত রকম কায়দাকানুন আছে- সব করেছে। বিএনপিকে মাজাভাঙা পার্টি বলেছে। কিন্তু এবার জেলা ও বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর পর জনস্রোত সবাই দেখেছে। দু-তিন দিন আগে গণপরিবহন বন্ধ করেও পরীক্ষায় ফেল করেছে। অসংখ্য মানুষকে হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেও সমাবেশ বন্ধ করতে পারেনি। বিএনপিকে ভাঙার বহু চেষ্টা হয়েছে, সফল হয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসন গৃহবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে, মহাসচিবসহ বহু নেতাকর্মী জেলে; তার পরও ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছে।

সমকাল :'খেলা হবে, খেলা' স্লোগানটি বেশ সমালোচিত হচ্ছে। আপনিও সেই স্লোগান দিয়েছেন?

রুমিন ফারহানা :আমারটা ছিল জবাব। একবার দিয়েই আমি থেমে গেছি। জবাব বারবার দিতে হয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রতিদিন সকাল-বিকেল বলছেন। এখন বিশ্বকাপ চলছে- সেখানে খেলা নিয়ে আসছেন। বিএনপির সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল চলছে। সেমিফাইনাল হবে, তার পর ফাইনাল হবে। প্রতীকী অর্থে যদি বলি, সে খেলা হতে পারে দুটি দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং থাকবে, একজন নিরপেক্ষ রেফারি থাকবে, দুই দলের সমান সুযোগ থাকবে।

সমকাল :রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের উদ্বেগ ও সরকারের সতর্কতা সম্পর্কে কী বলবেন?

রুমিন ফারহানা :তারা যে রাষ্ট্রদূতদের বলেছে, ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাশের দেশে ভিক্ষা চেয়েছেন- না চাননি? মানসম্মান যা যাওয়ার আওয়ামী লীগের কারণেই যায়।

আরও পড়ুন

×