ফিরে দেখা আওয়ামী লীগের ২১ সম্মেলন
বঙ্গবন্ধু সভাপতি ৪ বার, শেখ হাসিনা ৯ বার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৪:১৪
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে ঘটনাবহুল ও দুর্গম বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ৭৩ বছরের আওয়ামী লীগ আজ সুদৃঢ় অবস্থানে। সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন চারবার এবং শেখ হাসিনা এ দায়িত্বে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৯ বার। ফলে আজ শনিবার দশমবারের মতো সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
আজ দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আগামীর পথরেখা নির্ধারণ করবে টানা তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের এ আয়োজন নিয়ে সব মহলে কৌতূহল ও উচ্ছ্বাসও রয়েছে। তবে বিগত ২১টি সম্মেলন নিয়েও আলোচনার কমতি ছিল না।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দলটিকে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয় নিয়ে পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসে দলটি; প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০১-২০০৬ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এবং ২০০৭-২০০৮ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হয় মহাজোট। ২০১৪ ও '১৮ সালের নির্বাচনেও দলটির বিপুল বিজয় অব্যাহত ছিল। টানা এই তিন মেয়াদের গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন-অগ্রগতি এনে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ২১ বার- ১৯৫৩, ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮১, ১৯৮৭, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৯, ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে টানা ৯ বার দায়িত্ব পালন করে আসছেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারবার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চারবার, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুইবার; এএইচএম কামারুজ্জামান, মহিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুল মালেক উকিল ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী একবার করে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) চেয়ারম্যান ছিলেন। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাঁচবার, জিল্লুর রহমান চারবার, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তিনবার, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক ও ওবায়দুল কাদের দুইবার এবং শামসুল হক ও আবদুল জলিল একবার করে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনে প্রথম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু আওয়ামী লীগের। 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' হিসেবে ওই সম্মেলনে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি; আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ, আলী আমজাদ খান অ্যাডভোকেট ও আবদুস সালাম খান অ্যাডভোকেটকে সহসভাপতি; শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি গঠিত হয়েছিল ৪০ সদস্যবিশিষ্ট।
১৯৫৩ সালের ৩ থেকে ৫ জুন ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সম্মেলনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সম্মেলনেই নির্ধারিত হয় দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র।
১৯৫৫ সালের ২১-২৫ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে মওলানা ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ওই সম্মেলনে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের লক্ষ্যে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি ছেঁটে ফেলে দলের নাম নির্ধারিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সেবারের আয়োজনে প্রথমবারের মতো অংশ নেন পাঁচজন নারী।
এর দু'বছর পর ১৯৫৭ সালের ১৩-১৪ জুন আরমানিটোলার নিউ পিকচার হাউস ও গুলিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সম্মেলনের আগে বিবিধ মতবিরোধের জের ধরে মওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। চতুর্থ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং আবারও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
সাত বছর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে দলের পঞ্চম সম্মেলনে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সম্মেলনে সভাপতি পদে উঠে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৮ সালের ১৯ ও ২০ অক্টোবর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সপ্তম সম্মেলনেও নেতৃত্ব অপরিবর্তিত থাকে। এ সম্মেলনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কৃষি সম্পাদক পদ সৃষ্টি করা হয়।
১৯৭০ সালের ৪ ও ৫ জুন দলের অষ্টম সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ স্ব-স্ব পদে আবারও নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৭২ সালের ৭ ও ৮ এপ্রিল তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত নবম (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম) সম্মেলনে কাউন্সিলরদের সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দায়িত্ব পড়ে নির্বাহী সংসদের অন্যান্য নেতা নির্বাচনের। ১৬ এপ্রিল তিনি জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে দলের ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি দলের দশম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন এএইচএম কামারুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সব দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে এর চেয়ারম্যান হন। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাধারণ সম্পাদক এবং জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সম্পাদকবৃন্দ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এর পর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ।
এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল দলের ১১তম সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এর আগে ১৯৭৬ সালে মহিউদ্দিন আহমেদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত কমিটি দলীয় কার্যাবলি পরিচালনা করে। ১৯৭৮ সালে দলের ১২তম সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে। তিন বছর টালমাটাল অবস্থায় চলে 'বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ'। একাধিক গ্রুপ প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
এর পর ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ১৩তম সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তৎকালে ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তখন আবদুর রাজ্জাক আবারও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পরের প্রতিটি সম্মেলনেই সভাপতি পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা এবং এখনও দক্ষ হাতে নৌকার হাল ধরে আছেন তিনি।
১৯৮৭ সালের ১-৩ জানুয়ারি দলের ১৪তম সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে নির্বাচিত করা হয়। এর আগে ১৯৮২ সালে আবদুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগ করলে সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দলের ১৫তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জিল্লুর রহমানকে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালের ৬ ও ৭ মে আউটার স্টেডিয়ামে দলের ১৬তম সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ। সভাপতি পদে শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুল জলিল। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের ১৭তম সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও আবদুল জলিল সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই দলের ১৮তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয় জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ১৯তম সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত রেখে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
দলের ২০তম সম্মেলন ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে সভাপতি পদে টানা অষ্টমবারের মতো নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন এনে ওবায়দুল কাদেরের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সর্বশেষ ২১তম সম্মেলন ২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে টানা নবমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের।