ক্ষমা চেয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের চিঠি
নতুন নেতৃত্ব খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রী
রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন (বাঁয়ে) ও গোলাম রাব্বানী
শাহেদ চৌধুরী
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ১৯:৩৬ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ০৩:৫৯
ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বের খোঁজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি
নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে
তিনি কথাও বলেছেন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন
এবং সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু)
জিএস (সাধারণ সম্পাদক) গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত কয়েকটি
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠানো
হয়েছে। ছাত্রলীগের প্যাডে রাব্বানীর স্বাক্ষরে গত বুধবার পাঠানো ওই চিঠিতে
দুই নেতার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমাও
চাওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে সর্বশেষ
গত মঙ্গলবার গণভবনেও গিয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি তারা। এ
প্রসঙ্গে গোলাম রাব্বানী জানান, তারা গণভবনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে দেখা করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য। তবে তারা প্রধানমন্ত্রীর
দেখা পাননি বলে গণভবন সূত্র জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে গত
সোমবার ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ
সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় ছাত্রলীগের বিষয়ে তাকে কিছু নির্দেশনাও দেন তিনি।
পরে এ নিয়ে ওবায়দুল কাদের যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের কয়েকজন সমকালকে
জানান, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ না হলেও সংগঠনের দুই শীর্ষ পদে
নতুন নেতৃত্ব আনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও
যুগ্ম সম্পাদকদের মধ্য থেকে যোগ্য দুই নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতিও
শুরু হয়েছে।
তারা আরও জানান, তবে কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য
ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিধিসম্মত হয় কি না- সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অবশ্য ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী হলেন শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের সম্মেলনে
সংগঠনের সার্বিক দিকগুলো দেখভালের দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী তিনি ইচ্ছা করলেই ছাত্রলীগের স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে
পারেন বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার
মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে
নানা অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার
কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দুই নেতার
বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট নিয়েও কথা বলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়
নেতারা। অন্যদিকে আগে থেকে গণভবনে অপেক্ষমাণ ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ
সম্পাদক সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আওয়ামী লীগের
জ্যেষ্ঠ নেতাদের পরামর্শে তা থেকে বিরত থাকেন বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নানা সমালোচনা চলে
আসছিল। বিতর্কিত ব্যক্তিদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া ও অনৈতিক আর্থিক
লেনদেন, সম্মেলনের পরও একাধিক শাখায় কমিটি না দেওয়া, দুপুরের আগে ঘুম থেকে
না ওঠা, গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে চলা কিংবা ফোন না ধরা, সংগঠনের একাধিক
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েও নির্ধারিত সময়ের
অনেক পর উপস্থিত হওয়া অথবা অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে
সমালোচনামুখর ছিলেন খোদ সংগঠনের নেতাকর্মীরাই। এর ওপর ছাত্রলীগ সভাপতির
বিয়ের অভিযোগ প্রমাণ হওয়া ছাড়াও দুই নেতার বিরুদ্ধে ওঠা সংগঠনের নেত্রীদের
সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগ নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিলেন অনেকে। আওয়ামী
লীগের ৮ সেপ্টেম্বরের যৌথসভায় কয়েকজন নেতা এসব বিষয় তুলে ধরেন বলে বিভিন্ন
গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
এদিকে, ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী
লীগ নেতাদের ক্ষোভ প্রকাশের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।
কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখিও চলছে।
ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলনের দাবি তুলে ধরেছেন অনেকেই। কেউ কেউ নতুন সম্মেলন
ছাড়াই কেবল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন এনে কেন্দ্রীয় কমিটিরই
যোগ্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবি করছেন।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে পৌঁছানোর জন্য সংগঠনের প্যাডে সাধারণ সম্পাদক
গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ণাঙ্গকরণসহ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতার একজনের
কাছে দেওয়া হয়েছে। তিনিই চিঠিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে
দেবেন বলে জানা গেছে। ওই চার নেতার দু'জন চিঠিটি হাতে পাওয়ার কথা সমকালকে
নিশ্চিত করেছেন।
চিঠির শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে 'মমতাময়ী নেত্রী' সম্বোধন করে বলা হয়েছে-
আপনি বিশ্বাস করে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির যে পবিত্র পতাকা আমাদের হাতে তুলে
দিয়েছেন, তার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলাম। দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই
চতুর্মুখী চাপ, সদ্য সাবেকদের অসহযোগিতা, নানা ষড়যন্ত্র,
প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা আর আমাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত কিছু ভুল ইতিবাচক
পরিবর্তনের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করেছে। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণের ব্যর্থতা ও
কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির বাইরেও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, প্রিয় নেত্রী
দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভেঙে আপনি নিজে পছন্দ করে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বলে আমরা
একটি বিশেষ মহলের চক্ষুশূল। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে ও
প্রপাগাণ্ডা ছড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুকৌশলে আপনার এবং আওয়ামী লীগের
সিনিয়র নেতাদের কান ভারী করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়- আপনার সন্তানরা এতটা খারাপ না। আমরা পরিকল্পিত
ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি বারবার। অনেক অব্যক্ত কথা রয়েছে, যা আপনাকে বলার
কখনও সুযোগ পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রুত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত
সত্যটুকু উপস্থাপনের সুযোগ চাই।
চিঠিতে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়। তার বিভিন্ন অংশের উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হলো।
অভিযোগ-১ :২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নতুন পার্টি অফিসে আপনার আবেগের ঠিকানায়
আমাদের ঠাঁই দিয়েছেন। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আপনার আমানতকে সযত্নে
রেখেছি। অফিস অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা করা নিয়ে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা
সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহজাহান ভাই চায়
না ছাত্রলীগ এখানে থাকুক। লোক দিয়ে বাইরে থেকে ময়লা ফেলে, বাথরুম ও দেয়াল
অপরিচ্ছন্ন করে সেগুলোর ছবি তুলে আপনাকে দেখানো হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত
মিন্টু ভাই, লোকমান ভাই এবং ক্লিনার জাবেদ ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই
প্রকৃত সত্য জানতে পারবেন।
অভিযোগ-২ :২০ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনের দেরি প্রসঙ্গে- ১৮
জুলাই আপনি দেশের বাইরে যাবার আগে অনুমতি নিয়ে ১৯ তারিখ আম্মুর (সাধারণ
সম্পাদক) ১ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমি এবং সভাপতি মাদারীপুর গিয়েছিলাম।
ওই দিন সারারাত নির্ঘুম জার্নি আর বেশ কয়েকটি পথসভা (সর্বশেষ সকাল ৮টায়
সাভারে) করে সকাল ৯টায় ঢাকা ফিরি। রেস্ট নিয়ে পূর্বনির্ধারিত ১২টার
সম্মেলনে পৌঁছাতে আমাদের ৪০ মিনিট দেরি হয়, যা অনিচ্ছাকৃত এবং অনুষ্ঠানের
প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্বেই অবগত। সকালে ঘুম থেকে দেরিতে ওঠার
বিষয়টিও অতিরঞ্জিত। গত ১ বছরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সকল কর্মসূচিতে
(সকাল ৭টা-৯টা পর্যন্ত) আমরা উপস্থিত থেকেছি এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন
করেছি। ডাকসুর জিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মধুর ক্যান্টিনে কম
উপস্থিতি নিয়ে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা অতিরঞ্জিত।
অভিযোগ-৩ :জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অভিযোগ আপনার কাছে ভিন্নভাবে
উত্থাপন করা হয়েছে। উপাচার্য ম্যামের স্বামী ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে কাজের ডিলিংস করে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য
করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল আজহার পূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ খবর জানাজানি হলে
বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হয় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে
উপাচার্য ম্যাম আমাদের স্মরণ করেন। আমরা দেখা করে আমাদের অজ্ঞাতসারে
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিব্রতবোধ
করেন। নেত্রী, ওই পরিস্থিতিতে আমরা কিছু কথা বলি, যা সমীচীন হয়নি। এজন্য
আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
সবকিছুর পরেও আমাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত ভুলগুলোর জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, মানবতার মা। নিজ বদান্যতায় আমাদের ক্ষমা করে
ভুলগুলো শুধরে আপনার আস্থার প্রতিদান দেওয়ার সুযোগটুকু দিন। আপনি মুখ
ফিরিয়ে নিলে যাবার কোনো জায়গা নেই।
-আপনার স্নেহের রাব্বানী।
- বিষয় :
- ছাত্রলীগ সভাপতি