স্বপন, আমিনুলসহ গ্রেপ্তার ৪৫৬

.
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৯:১৪ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০১:১৪
রাজধানীতে বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সংঘর্ষ এবং পরবর্তী সময়ে বিরোধী দলগুলোর হরতালসহ তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়। গত ছয় দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা, সংঘর্ষসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি-জামায়াতের কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে বুধবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অভিযান চালিয়ে আরও ৪৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন মামলা হয়েছে ৩০টি।
গতকাল রাজধানী থেকে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনসহ আরও চার নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, গ্রেপ্তার বাকি তিনজন হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ ও পল্লবী থানা যুবদল নেতা কিবরিয়া। তাদের মধ্যে আমিনুলকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া রাজধানী থেকে গত বুধবার বিএনপি-জামায়াতের ৯৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ওই দিন ডিএমপির বিভিন্ন থানায় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৪টি। সব মিলিয়ে ২১ অক্টোবর থেকে বুধবার পর্যন্ত রাজধানী থেকে বিএনপি-জামায়াতের ২ হাজার ২০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময় বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ৬৬টি।
সারাদেশে গ্রেপ্তার, মামলা
গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগের আট জেলা থেকে বিএনপি-জামায়াতের ১২৬ নেতাকর্মী এবং মহানগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭ জনকে। সিলেট বিভাগে নতুন গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৬ জন। মামলা হয়েছে দুটি। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক সপ্তাহে এ বিভাগে ২১ মামলায় ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার হয়েছেন খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান। বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার দিনভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ জেলা থেকে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের আরও ১১ নেতাকর্মীকে আটক করে। ডিবি পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পরও সন্ধান মেলেনি জেলা ছাত্রদল সভাপতি আবদুল মান্নান মিস্ত্রির।
দীঘলিয়ায় ককটেল বিস্ফোরণ ও উদ্ধারের ঘটনায় নতুন একটি মামলা হয়েছে।
গতকাল ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪০ নেতাকর্মী। আর গত ছয় দিনে এ বিভাগে নতুন মামলা হয়েছে ১১টি। এ সময়ে ময়মনসিংহ থেকে ১৭৩, জামালপুরে ৮৫, নেত্রকোনায় ৯৭ ও শেরপুরে ৫৬ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বুধবার গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরণের দুই মামলায় বিএনপির ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কর্ণফুলীতে বাসে আগুনের অভিযোগে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় যুবদলের ৫ জনকে।
এ ছাড়া বুধবার রাতে এবং গতকাল অভিযান চালিয়ে বগুড়ায় বিএনপির ৭ জনকে গ্রেপ্তার এবং সদরের মাটিডালি থেকে চার যুবককে আটক, পঞ্চগড়ে শিবির নেতাসহ দুই কর্মী, সিরাজগঞ্জের ৯ উপজেলায় জামায়াত-বিএনপির ৩০ নেতাকর্মী, রাজবাড়ী সদরসহ তিন উপজেলায় নতুন তিন মামলা এবং ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মেহেরপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপি, যুবদল ও জামায়াতের ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কুষ্টিয়ায় নতুন তিন মামলায় আটক হন ১০ জন। কুমিল্লার তিতাসে নাশকতার মামলায় বিএনপির ৭, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে ৩, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে উপজেলা বিএনপির সভাপতিসহ ৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় বিএনপির ৩, পাবনার চাটমোহর থেকে বিএনপি ও যুবদলের ২, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যুবদল ও ছাত্রদলের ৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে ট্রাকে ভাঙচুর চালিয়ে পালানোর সময় গতকাল ককটেলসহ ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় মিছিল ও যানবাহনে ভাঙচুর চালানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয় যুবদলের ৩ নেতাকে। বরিশালের বানারীপাড়ায় বুধবার রাতে ককটেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছে বিএনপির ৬ জন। মামলাও হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় একই রাতে ককটেল বিস্ফোরণের পর পালানোর সময় আটক করা হয়েছে জামায়াত-বিএনপির ১০ নেতাকর্মীকে।
এ ছাড়া নড়াইল ও লোহাগড়ায় গত তিন দিনে দুই মামলা এবং বিএনপির ২১ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফেনীর ফুলগাজীতে গতকাল গাড়ি ভাঙচুর এবং আহতের ঘটনায় নতুন মামলা এবং গাইবান্ধার ফুলছড়িতে মাদ্রাসা থেকে ককটেল ও পেট্রোল বোমা উদ্ধারের ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছে।
ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ১৩ যানবাহনে আগুন
রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে গত বুধবার রাত ১২টা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৩টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর, উত্তরা আজমপুর, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ও দিলকুশায় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চারটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। অবরোধের আগের দু’দিনের মতো গতকালও সকাল থেকে রাজধানীতে যানবাহন চলাচল ছিল কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও মানুষের চলাচল বাড়তে থাকে। এদিনও রাজধানী থেকে দূরপাল্লার অধিকাংশ বাস ছাড়েনি। যাত্রীসংখ্যা ছিল কম। সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালের চিত্র ছিল একই রকম। গাবতলীতে বাস ছাড়তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী ও পুলিশ চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এদিন রাজধানীর বাড্ডা, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, দোলাইরপাড়, ধানমন্ডি, বাংলামটর, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, নীলক্ষেত, গ্রিন রোড, দয়াগঞ্জ, পল্টন, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসহ সমমনা দলগুলো। শাহজাহানপুর-শহীদবাগ, খিলক্ষেত, শান্তিনগর এলাকায় পিকেটিং করে স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও ছাত্রদল কর্মীরা। দুপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান তিন গেটে তালা দেয় ছাত্রদল। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা তালা ভেঙে ফেলে।
সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে বাইপাস সড়কে ছাত্রদল ও যুবদল একটি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়। কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর চালানো হয়। পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ শটগানের ছররা গুলি ছুড়লে আহত হন মুড়াপাড়া কলেজ ছাত্রদলের সদস্য মেহেদী হাসান মিরাজ ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হাসিব। এ ছাড়া আগের রাতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীর বাড়িঘরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ বিএনপির। সোনারগাঁয়ে ট্রলার নিয়ে যুবদল ও ছাত্রদল কর্মীরা মেঘনা নদীতে নৌযান চলাচলে বাধা দেয়।
রাজশাহীতেও বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়। বাঘায় আগের রাতে একটি চলন্ত পিকআপে পেট্রোল বোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে চালক-হেলপারসহ তিনজন আহত হন। চারঘাটে গভীর রাতে নিমপাড়া ইউনিয়নের বাসুপাড়া কাঠের রেলওয়ে ব্রিজের লাইনে টায়ার জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আগুন। আনসার ও পুলিশের টহল দল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর বাজারে ছাত্রদলের মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিহাশের মোড় এবং কাঁটাখালী এলাকায় পিকেটিং করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী।
বগুড়ায়ও সকালে ট্রাকে আগুন, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও ছররা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গুলিবিদ্ধ হন তিন বিএনপি কর্মী। সদরের সাবগ্রাম এলাকায় মিছিল করেছে জামায়াত নেতাকর্মীরা।
চট্টগ্রাম নগরীতে সহিংসতা বা ভাঙচুর হয়নি। ফেনীতে ভোরে একটি চিনিবাহী ট্রাকে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। ফুলগাজীতে সকালে ওষুধ কোম্পানির গাড়ি ভাঙচুর করে অবরোধ সমর্থকরা। এ সময় চালক আবদুর রহিম, বিক্রয় প্রতিনিধি সিফাত ইবনে ইউছুফ ও সহকারী কামরুল হাসান আহত হন। রাঙ্গুনিয়ায় ভোরে দুটি বাস ভাঙচুর ও একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় বুধবার রাতে একটি বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। হবিগঞ্জে সকালে গাড়ি ভাঙচুর ও সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। পিকেটিংয়ের চেষ্টা হয়েছে কিশোরগঞ্জেও। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনীমহল গ্রামে ভোরে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। ফরিদপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও পিকেটিং করে স্বেচ্ছাসেবক দল। এ সময় মহাসড়কে কয়েকটি ট্রাক ও পিকআপভ্যান ভাঙচুর করা হয়। গাইবান্ধার ফুলছড়িতে একটি মাদ্রাসা থেকে আটটি ককটেল, ছয়টি পেট্রোল বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। নড়াইলে বিএনপি নেতাকর্মীরা লোহাগড়া সড়কের সিমাখালী এলাকায় ব্যারিকেড ও মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতে গেলে র্যাব এবং পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
রাজবাড়ীর কালুখালী চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বুধবার রাতে ককটেল বিস্ফোরণ ও মোটরসাইকেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে সড়ক অবরোধ করতে গিয়ে তিন বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন। বরগুনা সদর উপজেলায় আঞ্চলিক সড়কে দুপুরে একটি ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়। বরিশাল নগরীর রূপাতলী এলাকায় কয়েকটি বাসে ইটপাটকেল ছোড়েন বিএনপি কর্মীরা। ময়মনসিংহেও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত পিকেটিং হয়।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের তেমুখী বাইপাস ও সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের কুতুবপুর এলাকায় এ দিন টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। হবিগঞ্জেও টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করা হয়।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সমকাল প্রতিবেদক, ব্যুরো, অফিস, ও প্রতিনিধিরা)