সক্রিয় ইসলামী দলগুলো বিএনপির দিকে তাকিয়ে

.
রাজীব আহাম্মদ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:২৯ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:৪১
কওমি মাদ্রাসা ঘরানার নিবন্ধিত ছয় ধর্মভিত্তিক দলের চারটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নিজেদের মতো করে সক্রিয়। বিএনপির দিকে তাকিয়ে থাকা এ দলগুলো আগামী নির্বাচনে কোন ভূমিকায় থাকবে, তা নিশ্চিত নয়। একটি দলের অবস্থান প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে; আরেকটি সরকারঘেঁষা। দরবার ও সুফিপন্থি পাঁচটি দলই রয়েছে আওয়ামী লীগের দিকে।
নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করলেও নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বিএনপির দিকে না যেতে ‘চাপ’ রয়েছে কওমি ঘরানার দলগুলোর ওপর। দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাকে চাপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দলগুলোর সূত্র। বিএনপি বর্জন করলেও আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে আসন দেওয়ার টোপও রয়েছে।
কওমি ঘরানার সবচেয়ে বড় দল চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরব। আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগ করে জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলটিমেটাম দিয়েছে গত শুক্রবারের মহাসমাবেশে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামা বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সমর্থনের কথা জানিয়েছে তারা।
১০ নভেম্বরের পর সব বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে কঠোর ও বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন চরমোনাই পীর তথা ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। এত স্পষ্ট ঘোষণার পরও দলটিকে নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ, গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী রাজপথে নামতে না পারলেও ইসলামী আন্দোলন এ ডামাডোলের মধ্যে প্রায় নির্বিঘ্নে ঢাকায় বড় মহাসমাবেশ করতে পেরেছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে আলোচনায় আসা ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের সখ্য থাকার গুঞ্জন অনেক পুরোনো। দলটিকে আগামী নির্বাচনে নিতে ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে নানা তৎপরতার কথাও শোনা যাচ্ছে। এ বছরের শুরু থেকে কয়েক মাস বিএনপির চেষ্টা ছিল জামায়াতের বদলে ইসলামী আন্দোলনকে কাছে টানার। বিএনপি নেতারা দলটির কর্মসূচিতেও যান বেশ কয়েকবার। তবে চরমোনাই পীর বিএনপির সঙ্গে যাননি।
আবার গতকাল শনিবার নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপেও যায়নি ইসলামী আন্দোলন। দলের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ সমকালকে বলেন, ইসলামী আন্দোলনের অবস্থান স্পষ্ট– কোনো পাতানো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বৃহত্তর কর্মসূচি বিষয়ে তিনি বলেন, যারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, তাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হবে করণীয়।
এক সময় বিএনপির জোটে ছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটিকে চারটি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। তবে ২০২১ সালের হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সহিংসতার মামলায় দলীয় নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির জোট ছাড়ে জমিয়ত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে দুটি আসনে ছাড় পাওয়া খেলাফত মজলিস একই কারণে জোট ছাড়ে। এই দুই দলসহ কওমি ঘরানার আটটি ইসলামী দলগুলো নিয়ে মোর্চা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল ইসলামী আন্দোলন। সে উদ্যোগ সফল হয়নি। ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা সমকালকে বলেন, প্রতিটি দল কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সঙ্গে রয়েছে। ইসলামী আন্দোলন তার নেতৃত্বে মোর্চা করার চেয়ে বড় দলের সঙ্গে থেকে সংসদে আসন পাওয়াকে গুরুত্ব দেয়। আবার সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি নির্ভরতাও রয়েছে। এসব কারণেই উদ্যোগ সফল হয়নি।
বিএনপির জোট ছাড়লেও জমিয়ত এবং খেলাফত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নিজেদের মতো কর্মসূচি করছে। তবে একই দাবিতে বিএনপি, জামায়াত ও সমমনাদের ডাকা কর্মসূচিতে নেই। নির্বাচন কমিশনের সংলাপ বর্জন করা এ দুই দল আগামী নির্বাচনে কী করবে, এখনও অনিশ্চিত।
খেলাফতের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের সমকালকে বলেন, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে– নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে পরিস্থিতি দেখে।
জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে তপশিলের পর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
২০০৬ সালে বিএনপির জোট ছেড়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গিয়েছিল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। কারাবন্দি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন দলটিও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে নিজেদের মতো কর্মসূচি পালন করছে। দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন সমকালকে বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত। তবে তিনি আশাবাদী, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে।
২০১৭ সালে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সরকারের সঙ্গে ইসলামী ঐক্য জোটের ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যাচ্ছে। দলটি নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়েছে। দলের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘আমরা তৃতীয় পক্ষ। নির্বাচনে অংশ নেব কিনা, তা পরে বলি।’
আরেক নিবন্ধিত দল খেলাফত আন্দোলন রাজনীতিতে নীরব। কামরাঙ্গীরচরের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দলটির সরকারের সঙ্গে সখ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। দলের আমির আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জির মারফত সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে হেফাজত। রাজনীতি, নির্বাচন নিয়ে দলটির চোখে পড়ার মতো তৎপরতা নেই।
দরবারভিত্তিক তরীকত ফেডারেশন ১০ বছর ধরে রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। জাকের পার্টি ক্ষমতাসীনদের জোটে না থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুফি ধারার দুই দল ইসলামিক ফ্রন্ট এবং ইসলামী ফ্রন্টও সরকারের ঘনিষ্ঠ। এ দুই দলও সংবিধান অনুযায়ী তথা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
এ বছর বহু আলোচনার জন্ম দিয়ে নিবন্ধন পেয়েছে মাইজভান্ডারী দরবারের দল বিএসপি। অভিযোগ রয়েছে, শর্ত পূরণ করতে না পারলেও সরকারের আনুকূল্য পেয়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে দলটি। নির্বাচনে অংশ নিতে আরও পাঁচটি অনিবন্ধিত দল নিয়ে জোট করেছে বিএসপি।