পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারের হিড়িক পড়েছে আওয়ামী লীগে। গতকাল তৃতীয় ধাপের ৬২টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দল মনোনীত প্রার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জয়ী হলেও বেশ কয়েকটিতে নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বিষয়টিকে উদ্বেগজনক মনে করা হচ্ছে। অবশ্য তাদের এবার আর ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো পৌরসভায় তাদের নির্বাচনের আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে। কয়েকটিতে নির্বাচনের পর তাদের দল থেকে বহিষ্কার করার সুপারিশ কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে আঁতাতের অভিযোগ উঠেছে দলটির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের অনীহার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন নেতার আঁতাতের ঘটনায় ভোটে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি বলে মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন ও আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে। অবশ্য তারা তা অস্বীকার করছেন।

ভোট বাড়ায় সন্তোষ, বিদ্রোহে অসন্তোষ : আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা অবশ্য গতকালের নির্বাচনে ভোটের হার বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, প্রথম ধাপে ৬৫ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৬২ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপে ৭০.৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল জয় পেয়েছেন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সমকালকে জানিয়েছেন, যেসব নেতাকর্মী দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করছেন, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে যারা জয় পেয়েছেন, তাদের এবার দলের মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আবদুর রহমান বলেছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনেই দলের মনোনয়ন পাবেন না। এমনকি তারা দলীয় পদ-পদবিও পাবেন না। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অবশ্য কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকালের নির্বাচনে সিলেটের গোলাপগঞ্জে জয়ী এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। এর মধ্যে আমিনুল ইসলাম রাবেল জয় পেয়েছেন। তিনি গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকারিয়া আহামদ পাপলু গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক।

জকিগঞ্জ পৌরসভায়ও বিদ্রোহী দুই প্রার্থী নির্বাচনে পরস্পরের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন। এর মধ্যে বিজয়ী প্রার্থী আব্দুল আহাদ জকিগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক। বিজিত প্রার্থী ফারুক আহমদ জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। এই চার নেতাকেই ইতোমধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক বলেছেন, গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে জয় পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থী মুকিতুর রহমান রাফিকে দলের পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশে তাকে সাময়িকভাবে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। তিনি গৌরীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হয়েছেন ঈশ্বরগঞ্জে। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল বলেছেন, বিদ্রোহী দুই প্রার্থীকেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওদুদ এমপি বলেছেন, দ্রুতই রহনপুর পৌরসভার বিদ্রোহী প্রার্থী মতিউর রহমান মতি খানকে দল থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব কেন্দ্রে পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত, মতিউর রহমান মতি খান রহনপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী আবুল বাশার চৌকদার। তিনি ভেদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী ইদ্রিস মাদবর জাজিরা পৌরসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবিদুর রহমান খোকা শিকদার জানান, আগামী দু-চার দিনের মধ্যে এ দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠানো হবে।

তবে বগুড়ার ধুনট পৌরসভায় নির্বাচিত দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এ জি এম বাদশাকে দল থেকে বহিষ্কার করার সুপারিশ কেন্দ্রে পাঠানোর বিষয় এখনও চিন্তায় আনেননি বলে জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু। তিনি বলেছেন, এ জি এম বাদশা এর আগেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। এ জন্য দল থেকে বহিষ্কার করায় তিনি ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারিয়েছিলেন। পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলে তিনি দলে সক্রিয় হন। কিন্তু গত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় এবার তাকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

আঁতাতের অভিযোগ বিএনপিতে : পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানামুখী জটিলতায় পড়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। যোগ্য প্রার্থীদের অনীহার পাশাপাশি অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন ও আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগে উৎকণ্ঠিত দলের হাইকমান্ড। দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোয় অযোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনাও দলে আলোচিত হচ্ছে। সরকারি দলের রোষানলের ভয়ে কয়েকটি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে গেছেন বলেও জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। স্থানীয় নেতারা এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ফেনী জেলা বিএনপির নেতারা। জেলার পাঁচ পৌরসভার তিনটিতে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মেয়র ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রার্থী দেওয়া হয়নি। দাগনভূঞা পৌরসভায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৯টি সাধারণ ও তিনটি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী ছিল না। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপির প্রার্থী। খুলনার পাইকগাছা, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর ও মৌলভীবাজারের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। পিরোজপুর সদর, পাবনার ভাঙ্গুরা ও নারায়ণগঞ্জের তারাব, কুমিল্লার লাকসামে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হলে তার বিরুদ্ধে রহস্যজনকভাবে আপিল করা হয়নি।

তৃণমূল নেতারা জানিয়েছেন, এসব চলতে পারে না। প্রতিটি নির্বাচনেই বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে নির্যাতন, হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। এটা নতুন কিছু নয়। তাই বলে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কোনো প্রার্থী নির্বাচনে থাকবে না, এটা হয় না। অবশ্য সংশ্নিষ্ট প্রার্থীরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আসনের (ফেনী-১, ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া) আওতাধীন পরশুরাম পৌরসভায় দলীয় প্রার্থী দিতে না পারায় জেলা ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এ আসন থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন খালেদা জিয়া। এখানেই তার পৈতৃক ভিটা। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত এ আসনের পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি, যা খুবই দুর্ভাগ্যের।

এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাউদ্দিন আলাল জানিয়েছেন, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, দলীয় মনোনয়নে মেয়র পদপ্রার্থী হলেও ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন নেই। তারপরও বিএনপি থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু মনোনয়নপত্র নিয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা জমা দেওয়া হয়নি। আবার যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ তা প্রত্যাহার করেছেন।

ফেনী জেলা বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতারা বলেছেন, পৌর বিএনপি আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনের নামে পকেট কমিটি করেছেন। এ দুই নেতা তাদের নিজস্ব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর একটি ওয়ার্ডেও বিএনপির ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ছিল না। দলের পৌর সদস্য সচিবের নিজের ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি সভাপতি। এসব বিষয় কেন্দ্রীয় দপ্তরে জানানো হয়েছে।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ জোবায়েরকে সমর্থন জানিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এ জেড এম মঈনুল হক চৌধুরী। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময়ও করেছেন এই নেতা। খুলনার পাইকগাছা পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি।

স্থানীয় বিএনপির কোন্দলের কারণে দুর্বল প্রার্থী দেওয়া হয় কুমিল্লার লাকসামে। ওই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও কোনো আপিল করা হয়নি। এ পৌরসভায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রার্থী দিতেও পারেনি স্থানীয় বিএনপি। দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে চৈতি কালামের দ্বন্দ্বের কারণে এমন হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী।

পিরোজপুর সদর পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী ছিলেন জেলার যুগ্ম সম্পাদক শেখ শহীদুল্লাহ। কিন্তু হলফনামায় তথ্য গোপনের অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নেতারা। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী পৌর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তার বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে কিছু অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। সেসব অভিযোগ তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যে প্রক্রিয়ায় এবং যেভাবে হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হচ্ছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে আপিলের প্রতিও অনাগ্রহ প্রার্থীদের।