নৌকার পথ আটকে দাঁড়িয়ে ঈগল

কোলাজ
রাজীব আহাম্মদ ও নুরুল ইসলাম, নরসিংদী থেকে
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০:০৮ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০:৩২
নরসিংদীর পাঁচ আসনের চারটিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে নৌকাকে টক্কর দিচ্ছেন ভোটের মাঠে ও প্রচারে। নৌকা ও ঈগল– এ দুই ধারায় ভাগ হয়েছেন শাসক দলের পদধারীরা। এতে সংঘাতের শঙ্কা যেমন আছে; তেমনি ধারণা করা হচ্ছে, নৌকা হারতে পারে একাধিক আসনে।
নরসিংদী বিএনপির শক্ত ঘাঁটি ছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনেই জেতে ধানের শীষ। পরেরবার ক্ষমতা হারালেও তিনটি আসন পায় বিএনপি। নরসিংদী-৪ আসনে পরাজিত হয় মাত্র হাজার ভোটে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর নরসিংদী-৫ বাদে সব আসনে জেতে ধানের শীষ।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে পরিস্থিতি বদলে যায়। সব আসনেই জেতে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তিনটি আসনে নৌকা ও দুটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরা ভোটের প্রচারেই নামতে পারেননি। ফের পাঁচটি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ এবার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা দেয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াইয়ে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে আশা করছে ক্ষমতাসীনরা।
নৌকা ও ঈগলের প্রার্থীদের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনী মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেও গতকাল রোববার নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেল, ভোটারদের আগ্রহ কম। নৌকা ও ঈগলের নির্বাচনী ক্যাম্পে নেতাকর্মীর জটলা এবং মাইকে প্রচার চললেও উপচে পড়া ভিড় নেই। চায়ের দোকান ও বাজারগুলোতে নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে। যেমন সদর উপজেলার চরাঞ্চলের করিমপুর বাজারে ছোলা বিক্রেতা বশিরুল আলমের ভাষ্য, ভোট তো আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরা করছে। ভোট দিলেই কী আর না দিলেই বা কী!
বিএনপি বর্জন করায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরসিংদীর দুটি আসনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। বাকি তিন আসনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ২৬ থেকে ৪৫ শতাংশ। এই তিন আসনের দুটিতে নৌকা হেরেছিল। এবার ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ।
পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত নরসিংদী জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নানা ধারায় বিভক্ত। এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধি খুন হয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে নিহত হন শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান। তাঁর ভাই রবিউল আলম খান কিরণও খুন হয়েছিলেন। গত অক্টোবরে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা রানা আকবর মোল্লা। সবচেয়ে আলোচিত ছিল নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে দলীয় প্রতিপক্ষের নাম আসে।
এদিকে ‘স্বতন্ত্র-মতন্ত্র চিনি না, মাইরের উপর ওষুধ নাই’– ঈগলের প্রার্থীকে এভাবে পেটানোর হুমকি দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমন। তাঁকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁকে পেটানোর হুমকি দেওয়া হয়, সেই কামরুজ্জামান কামরুল ইসলাম সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-১ আসনে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী। এ আসনে টানা চারবার নৌকা পাওয়া বর্তমান এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীকের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। ২০১১ সালে নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের ভাই কামরুল। তিনি নিজেও দুইবারের সাবেক মেয়র, শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী হিরুর বিরুদ্ধে আরও ছয় প্রার্থী থাকলেও লোকমানের ভাবমূর্তির কারণে কামরুলই তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ২০২১ সালের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি কামরুল। সেই নির্বাচনে জয়ী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আমজাদ হোসেন বাচ্চুও রয়েছেন ঈগলের পক্ষে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ আলী, মাধবদী পৌরসভার মেয়র ও মাধবদী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন প্রধান মানিক, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজও কামরুজ্জামানের পক্ষে।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জিএম তালেব হোসেন ভোটের প্রচারে রয়েছেন নৌকার পক্ষে। ছাত্রলীগও নৌকার পক্ষে মাঠে রয়েছে। স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে এলাকায় নবাগত ছিলেন হিরু। সেবার তিনি মেয়র লোকমান হোসেনের নিরঙ্কুশ সমর্থন পান। গত ১৫ বছরে নিজের শক্তি বাড়িয়েছেন। নানা উপদলে বিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ রেখেছেন। জিএম তালেব বলেন, ‘জেলার সহসভাপতিসহ জ্যেষ্ঠ নেতা সবাই নৌকার পক্ষে আছেন। জেলার সাধারণ সম্পাদকও এখন আর ঈগলের প্রচারে যাচ্ছেন না। যারা আওয়ামী লীগের, তারা নৌকাতেই ভোট দেবেন।’ কামরুলের বিরুদ্ধে বিদ্যমান নানা অভিযোগের প্রতি ইঙ্গিত করে জেলা সভাপতি বলেন, ‘মানুষ ভালোকে গ্রহণ করবে, খারাপকে বর্জন করবে।’
ভোটের প্রচারে শুরুতে ঈগলের পক্ষে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অসুস্থতার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রামে আছি। কারও পক্ষেই নেই।’ ফের ঈগলের হয়ে প্রচারে নামবেন কিনা– প্রশ্নের জবাব দেননি কাজী মোহাম্মদ আলী।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরসিংদী-১ আসনে প্রায় ২৬ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিলেন। ২০০৮ সালে ছিল ৮৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিমত, দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন না। জাতীয় পার্টি মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার নৌকা ও ঈগলের লড়াই জমে উঠায় ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। সেতু নির্মিত হওয়ায় চরাঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত হয়েছে। এতেও ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।
শিবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-৩ আসনে নৌকা পাননি বর্তমান এমপি জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক এমপি রবিউল আউয়াল খান কিরণের ছেলে ফজলে রাব্বি খান কিরণকে। মোহন নির্বাচনে না থাকলেও, নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন সাত প্রার্থী। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ঈগল প্রতীকের সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোহনকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
সিরাজুল ও মোহনের লড়াইয়ে দশম সংসদ নির্বাচনে জেলার সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল নরসিংদী-৩ আসনে। স্থানীয় নেতাদের ধারণা, বিএনপি ভোট বর্জনের আহ্বান জানালেও সিরাজুল ও মোহনের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস থাকায় এবার ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহসীন নাজিরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা নৌকার পক্ষে। যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং সহসভাপতি আবদুল হাইসহ আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন পাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল। তবে তাঁর দাবি, সবাই ঈগলের পক্ষে। তিনি বলেছেন, আর দু-এক দিনের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বেলাব ও মনোহরদী উপজেলা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-৪ আসনে প্রার্থী সবচেয়ে কম, চারজন। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন তিনজন। কিন্তু এ আসনেই নৌকা সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য। মনোহরদী উপজেলার পাঁচবারের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বিরু ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। তাঁর চাচা সাবেক সেনাপ্রধান নুরুউদ্দীন খান এ আসনের এমপি ছিলেন।
২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন নূরুল মজিদ। গত নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল নির্বাচনের প্রচারে নেমে আক্রান্ত হন। রক্তাক্ত হয়ে ভোটের মাঠ ছাড়েন। নির্বাচন ছিল নৌকার প্রার্থীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ভোটের প্রচারে নৌকার সমানে সমান দাপটে রয়েছে ঈগল। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় অংশই রয়েছে নৌকার পক্ষে। তবে সূত্রের খবর, তাদের অনেকে আবার গোপনে ঈগলের পক্ষে।
রায়পুরা উপজেলা নিয়ে গঠিত নরসিংদী-৫ আসনে টানা পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। সাবেক এই মন্ত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী আটজন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। ঈগল প্রতীকের এ প্রার্থী রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এক সময় তিনি রাজিউদ্দিনের অনুসারী ছিলেন। দলীয় সমর্থন না পেলেও ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে রাজিউদ্দিনের আশীর্বাদে উপজেলা নির্বাচনে জয় পান। রাজিউদ্দিন নিজে এখনও ভোটের প্রচারে নামেননি। তাঁর অনুসারীরা প্রচার চালাচ্ছেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী নিজেই নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন।
পলাশ উপজেলা এবং সদরের তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নরসিংদী-২ আসনে ভোট বাকি চার আসননগুলোর তুলনায় অনেকটাই নিরুত্তাপ। বর্তমান এমপি ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ আবারও নৌকার প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী আরও তিনজন। জাতীয় পার্টির রফিকুল আলম সেলিমের প্রচার খুব একটা নেই। ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসুম বিল্লাহর প্রচুর পোস্টার ব্যানার দেখা গেছে ঘোড়াশাল এলাকায়। তিনি পাঁচদোনা স্যার কেজি গুপ্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জাসদের জায়েদুল কবিরকে নরসিংদী-২ আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ডা. দিলীপের ভাই কামরুল আশরাফ খান পোটন ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার জায়েদুল কবিরকে হারিয়ে দেন। ভোটার উপস্থিত ছিল ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস না থাকায় এ আসনে ভোটার কেন্দ্রে আনাই আওয়ামী লীগের মূল চ্যালেঞ্জ।