ফের ভারতবিরোধী অবস্থান জোরদার করবে বিএনপি

লোগো
কামরুল হাসান
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৫:৫৩
নানা হিসাবনিকাশ কষে ক্ষমতাধর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের দৃশ্যমান পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দলটির। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করেও কোনো সুফল না পাওয়ায় ‘ভারত বিরোধিতাকে’ ফের সামনে আনছে তারা। এরই মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে দলটির ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতাকর্মীর মধ্যে। আগামী দিনে তা আরও জোরদার করার সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিপক্ষে অভিযুক্ত করে জনগণকেও ভারতবিরোধী অবস্থানে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা করছে বিরোধী দলটি। সুদূরপ্রসারী সুফল পেতে এ ইস্যুকে ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন দলের হাইকমান্ড। এবার ‘ভারতবিরোধী মনোভাব’ তীব্র করে জনগণের মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, ভারতের একতরফা সমর্থনে আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ, যা তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। বাংলাদেশি নাগরিকদের ভাগ্য এখন দিল্লি ছিনিয়ে নিয়েছে। দিল্লি তার নিজ স্বার্থের জন্য গণতন্ত্র হত্যায় মূল ভূমিকা পালন করতে বাংলাদেশের মানুষের বিরুব্ধে অবস্থান নিয়েছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুমত ও সহনশীলতার নীতিকে অগ্রাহ্য করে প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা, অন্য কথায় গণতন্ত্রকে বর্জন করে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকাকে অপরিহার্য গণ্য করছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কথিত স্থিতিশীলতার বাংলা হলো স্বৈরতন্ত্র!
জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল বিএনপি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর থেকে দফায় দফায় দলের প্রতিনিধি দল ওই দেশে সফরে গিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ভারতবিরোধী কোনো অবস্থান নেওয়া হবে না বলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গিয়ে ‘ভারতের সঙ্গে বিএনপির বৈরী আচরণ ভুল ও বোকামিপূর্ণ ছিল’ বলে স্পষ্ট করা হয়। তখন থেকেই মনে করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে দলটি ভারতবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ওই নির্বাচনের পরও বিএনপি ভারতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে।
সূত্র জানায়, ভারতের বিষয়ে অনেক দিন নরম সুর দেখায় দলটি; যাতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, কোনো দলের পক্ষে না গিয়ে দেশের জনগণের পক্ষে থাকে– সে রকমটাই চেয়েছিল বিএনপি। তবে সেই ইতিবাচক অবস্থানের বিপরীতে নেতিবাচক অবস্থান নেওয়ায় বিএনপি নেতারা তাদের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাইছেন। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বক্তব্য-বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছেন দলটির নেতারা। সেখানে বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে অভিযোগ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন দলটির নেতারা।
একইভাবে দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলকে আবারও কাছে টানার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন দলের হাইকমান্ড। আজ-কালের মধ্যে আন্দোলনের নতুন মাত্রা হিসেবে জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চে আসার ঘোষণা আসতে পারে বলেও জানা গেছে। এরই মধ্যে তাদের মধ্যকার কয়েক বছরের দূরত্বকে ঘোচানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে দুই দলের তরফ থেকেই। এ দুই দলের নেতারাই মনে করছেন, ভারতকে কাছে টানার চেষ্টা, তাদের নিরপেক্ষ রাখার বিষয়ে তাদের বিগত দিনের সব প্রক্রিয়া ভুল ছিল।
বিরোধী দলটির সূত্র জানায়, নির্বাচন বিষয়ে ভারতের অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে সব ক্ষেত্রেই। দলের যেসব কেন্দ্রীয় নেতা এতদিন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন, তারা এখন দলে কিছুটা কোণঠাসা অবস্থায়। নির্বাচন নিয়ে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ভারতীয় গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যকে তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ বলে দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেই মূলত বিএনপি তার কূটনীতি পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এর প্রভাব সব অঙ্গনেই ছড়িয়ে পড়বে। সম্প্রতি ক্রিকেট খেলা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেটাও একটা প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে এর বিরূপ প্রভাব। আর এটাকেই কাজে লাগাতে চাইছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল; যেখানে জনগণের কাছে ভারতের অবস্থান তুলে ধরার প্রক্রিয়া থাকবে।
দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, বিএনপি যতই চেষ্টা করুক, ভারত শেষ পর্যন্ত তার অবস্থান থেকে কখনও সরে যাবে বলে মনে করছেন না। তারা তাদের স্বার্থের বাইরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে কোনোদিন অবস্থান নেবে না। ওই দেশটি একটি নির্দিষ্ট দলকে ক্ষমতায় রাখার সব রকমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এমন নীতির কারণে এবার বিএনপিও তাদের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন আনতে চাইছে। দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থানকে আরও পোক্ত করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যেটাকে ইস্যু হিসেবে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে তারা। এতে দু’দিক থেকেই তারা লাভ দেখছেন– এক, জনগণের মধ্যে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে; দুই, বাংলাদেশের জনগণের বিপরীতে শুধু একটি দলের বন্ধু হিসেবে ভারতকে চিহ্নিত করা যাবে।
বিএনপির নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনের কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের চাপ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আরেকটি ‘বিরোধী দলহীন একতরফা নির্বাচনের’ দিকে এগিয়ে যেতে পারছে আওয়ামী লীগ সরকার। যে নির্বাচনে হাস্যকরভাবে নিজ দলের ডামি প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী নির্বাচনকে সমর্থন দেওয়ায় এ দেশের জনগণ থেকে ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পশ্চিমা বিশ্বের চাপ ও বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর দাবি উপেক্ষা করে দেশটি যে অবস্থান নিয়েছে, সেটি ভারতের ‘আরেকটি ভুল’ বলে মনে করেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে কাজ করেছেন। সেটা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আরও জোরদার করা হয়। এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে তাদের পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেন তারা। এ সময়ে ‘একলা চলো’ নীতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করে দেশের অনেক বন্ধু রাজনৈতিক দলের রোষানলে পড়েন; জনগণও তাদের এই নীতিকে ভালোভাবে নেয়নি। এর পরও বৃহত্তর প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন তারা।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেটাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে ওই সব ইসলামী দলের সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়া হয়। সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানির হিস্যা থেকে শুরু করে এ দেশে ভারতের তৎপরতার বিরুদ্ধে অনেকটা কৌশলগত নীরব অবস্থান নেয় দলটি। তবে এত কিছু করেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত তার আসল রূপ প্রকাশ করেছে। একটি দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনের নামে ‘তামাশা’ করছে। এটা বিএনপিকে যেমন বিস্মিত করেছে, তেমনি ভারতবিরোধী অবস্থানে যেতে তাদের বাধ্য করেছে বলে ওই নেতা মনে করছেন।
বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন স্পষ্টতই বাধাগ্রস্ত করছে ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সরকার’। তারা তাদের পছন্দের বাইরে যেতে পারছে না। সেখানে বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশাকে ভারত গুরুত্ব দেয় না।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগও শুরু করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় বিএনপির মধ্যে উদ্বেগ বাড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন না নেতারা।
দলটির নেতারা বলছেন, আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন তৎপরতা ছিল না। এবার দেশটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ দেখাচ্ছে। দেশটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দৌড়ঝাঁপও চোখে পড়ার মতো। ভারত কয়েক মাস ধরে নির্বাচন নিয়ে চুপচাপ ছিল। চীন, রাশিয়া নির্বাচন নিয়ে একাধিকবার কথা বললেও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেনি। ফলে এক ধরনের স্বস্তি কাজ করে বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে। তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ্যে আনে ভারত। এর পর থেকেই দলের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দেয়। ভারত তার অবস্থান জানান দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
তবে এখানে আশার আলো হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে বেছে নিতে চাইছেন দলটির নেতারা। তারা মনে করছেন, আগের দুই নির্বাচন নিয়ে নীরব থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবার সরব মানেই স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে।