এমন নির্বাচনে নিশ্চিত হবে না ভোটের অধিকার

কোলাজ
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৪ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২০:২৬
আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতির মৌলিক সংকটের সমাধান হবে না। নিশ্চিত হবে না মানুষের ভোটের অধিকার। ভোট দিতে হয়তো জোর করা হবে। সরকারও গঠিত হবে। এতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব আরও বাড়বে। এ অবস্থায় নীরবে, নিভৃতে ও নিরাপদে বসে থাকার ভাবনা হবে বোকামি। অবস্থার পরিবর্তনে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী এবং তরুণদের উচ্চকণ্ঠ হতে হবে।
গতকাল শনিবার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক এজেন্ডা’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এমন মনোভাব প্রকাশ করেছেন আলোচকরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সভাপতিত্বে রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেট সালমা আলী প্রমুখ অংশ নেন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে, তাকে নির্বাচন না বলে কী বলা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এ নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে, যদিও তা পরিষ্কারভাবে সাজানো। আবার হয়তো ভোটারদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলকও হবে। এতে কেউ স্বেচ্ছায় ভোট দিতে যাবেন। আবার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় থেকে বের করার হুমকির কারণেই হোক বা ভোট দিতে না গেলে নজরদারিতে পড়ার ভয়েই হোক– তার জন্য কেউ কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবেন। তবে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটের অধিকার নিশ্চিত হবে না।
তাঁর মতে, এভাবে হওয়া নির্বাচনকে আইনগতভাবে শুদ্ধও বলা যাবে, যা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকবে না। নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যম, দেশি-বিদেশি শক্তিসহ অনেক অংশীজন হয়তো নাখোশ হবেন। কিছু প্রতিবাদ করবেন কয়েক দিন। তার পর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রাজনীতিবিদদের প্রতি প্রশ্ন রেখে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাজনীতিবিদরা কি সম্পদ বিকাশের জন্য রাজনীতি করছেন, নাকি জনস্বার্থে রাজনীতি করছেন? যদি সম্পদ বিকাশের জন্য রাজনীতি করে থাকেন, তা খোলাখুলি বলে দিলেই পারেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রীর বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে, যা তিনিও অস্বীকার করছেন না। নির্বাচনী হলফনামায় এ তথ্য গোপন করার জন্য নির্বাচনে প্রার্থিতা থাকার কথা নয়। নির্বাচন কমিশন তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে, কিন্তু করছে না। দুদক দেখতে পারে, এ সম্পদ তিনি কীভাবে অর্জন করেছেন। কিন্তু সংস্থাটি বলেই দিয়েছে, অভিযোগ না পেলে তদন্ত করবে না।
তিনি বলেন, আইনের কোথায় আছে, অভিযোগ না পেলে দুদক তদন্ত করতে পারবে না? চাইলে বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) দেখতে পারে, তিনি বিদেশে এত বিশাল অর্থ কীভাবে নিলেন। এনবিআরও দেখতে পারে, এ সম্পদের বিপরীতে তিনি কর দিয়েছেন কিনা। এসব আদৌ দেখা হবে কিনা সন্দেহ পোষণ করে তিনি বলেন, হলফনামার তথ্য যাচাই করার বহু সুযোগ আছে। এখন কেউ যদি না দেখে, তবে কী করার আছে! আগামী সংসদে যদি এমন আইন হয়, হলফনামাপ্রথাই থাকবে না, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুই বছর আগে আমি চিন্তা করেছিলাম, ২০২৪ সালে নতুন কিছুর শুভসূচনা হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে এবং স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারণা ও নকশা নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং এর তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করব বলে আমি পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এমনই, এখানে যে যতবার নির্বাচন করেছে, তাঁর আয় ও সম্পদ গাণিতিক হারে ততগুণ বেড়েছে। সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির হারের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার সম্পর্ক আছে। এতে বোঝা যায়, কেন সবাই নির্বাচিত হতে চায়, কেন কিছু মানুষ নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে যায়।
তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকারের চেয়ে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ঢুকতে পারাটাই সবচেয়ে ভালো রাস্তা। এদের সঙ্গে থাকতে পারলে কিছু ভাগবাটোয়ারা পাওয়া যায়; নাগরিক হিসেবে যা পাওয়া যায় না। পুরো রাষ্ট্রকে অধিকারহীন করে সংকীর্ণ গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার ও মালিকানা দেওয়া হচ্ছে। এটি মুক্তবাকহীন এবং প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনের সবচেয়ে কুফলের জায়গা।
তিনি বলেন, হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণ এবং কর বিবরণী দেওয়া হয়েছে, তাতে তাঁর (প্রার্থীর) যে সম্পদ শত বা পাঁচশ গুণ বাড়ল, তিনি পাঁচশ গুণ কর দিয়েছিলেন কিনা, তা এখন দেখার বিষয়। কর-জিডিপি হার বাড়াতে আইএমএফের শর্ত পূরণে এনবিআরের জন্য এর থেকে ভালো উৎস আর কিছু হতে পারে না। আগামী চার মাসে এনবিআর কী করে, তা নজরে রাখতে হবে। হয়তো দেখা যাবে, সবাই (অধিক সম্পদ বেড়েছে এমন প্রার্থী) মুরগির খামারি বা মাছচাষি হয়ে গেছেন। কারণ, এসব খাতে তেমন কর দিতে হয় না, কর রেয়াত মেলে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচন যদি মৌলিক রাজনৈতিক সমাধান দিতে না পারে এবং বহু মানুষের মনোভাবকে অস্বীকার করে, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল টিকিয়ে রাখা কষ্ট হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস তাই বলে। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, এ অবস্থায় ইতিহাসের কাছে নাগরিকদের দায় আরও বেড়ে গেল। নিশ্চুপ থাকার সময় এখন নয়। কেউ যদি মনে করেন, এ অবস্থায় তিনি চুপচাপ, নীরবে, নিভৃতে ও নিরীহভাবে নিরাপদ থাকবেন এবং আটলান্টিকের ওপাশ থেকে দেশের সমাধান করে দিয়ে যাবে, তার মতো আর বোকা কেউ হতে পারেন না। সংকট সমাধানে যুবসমাজের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, নিজেদের সমস্যা নিজেদের সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তারা যদি কিছু না করেন, কেউ এসে কিছু করে দিয়ে যাবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন আসবে-যাবে, তবে দেশ থেকে যাবে। এখন যাকে নির্বাচন বলা হচ্ছে, একে আমি বলি বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা। এ তৎপরতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে সামাজিক শক্তির ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে; গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে। ইতিহাস বলে, যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হয় এবং বিচ্যুতি দেখা যায়, তখন নাগরিক কণ্ঠস্বরকে সামনে নিয়ে আসার বেশি প্রয়োজন হয়। কারণ, এ ধরনের বহুত্ববাদহীন এবং জবাবদিহিহীনতার পরিবেশে বৈষম্য বাড়ে, যা সরকারি পরিসংখ্যানে এসেছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ঘোষিত নির্বাচনের ইশতেহার নিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে (আওয়ামী লীগের) ইশতেহার ঘোষণা হলো, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে। এই ইশতেহারে এনজিও প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করার মনোভাব প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এদের (এনজিও) জবাবদিহি বাড়াতে হবে; নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। একবারও বলা হয়নি, এদের ভূমিকা বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে কেমন সহযোগিতামূলক হবে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময় দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তা নিয়ে কারও মধ্যে বিতর্ক নেই। জাতি হিসেবে গৌরব করার মতো অনেক কিছু অর্জন বাংলাদেশ করেছে। তবে সম্পদের বণ্টনের ন্যায্যতার দিক থেকে সমস্যা আছে। লিঙ্গভিত্তিক, প্রান্তিক, নীরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, এখন রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশ থেকে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। একটি বিশেষ দলের না হলে সরকারি সেবা পেতে বেগ পেতে হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম মনে করেন, দেশের সব ক্ষেত্রকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভাগ করা হয়েছে। গত ১০ বছরে বৈষম্য নিরোধ আইন হচ্ছে, হবে বলে চলছে। এতদিনেও যারা এ আইন করতে পারলেন না, এ জন্য তাদের লজ্জাবোধ নেই। কিন্তু আমরা যারা বলছি, তাদের এখন এ নিয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ হয়। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকদের সবাই এক একটা পাথর। অনেক অনেক শক্ত ও বিরাট পাথর। তবে পাথরটি গোল। ধাক্কা দিতে থাকলে নড়ে। নাগরিক প্ল্যাটফর্মে এই ধাক্কা দেওয়ার কাজটি সবাই মিলে করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে অতীতের মতো যে সংসদ পেতে যাচ্ছি, তাতে আমাদের উত্থাপিত দাবিগুলো পূরণ হবে বলে আশা করি না। নির্বাচনের ইশতেহারে নারীর অগ্রাধিকারের বিষয়টি নেই।
বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বলেন, সংসদে সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন। দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, নির্বাচন যখন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, তখন মানুষ বিশেষত প্রান্তিক মানুষের গুরুত্ব বাড়ে।
আলোচনায় ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল অ্যান্ড জেন্ডার অ্যানালিস্ট এমবি আকতার বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনে শেষ করার কথা থাকলেও তিন-চার বছর লেগে যাচ্ছে। নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, সাইবার সিকিউরিটি আইনে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। তাদের প্রতি সহিংসতা নয়, ভালোবাসার মনোভাব গড়তে মাদ্রাসাসহ সব পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্যক্রম আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব সবার ওপরই পড়ে; তবে বেশি পড়ে নীরব জনগোষ্ঠীর ওপর। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও সংকুচিত হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের প্রকৃত অবস্থা জানতে একটি জাতীয় তথ্যভান্ডার করা দরকার।
ব্রিফিংয়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও বৈষম্য কমাতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়া, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রাপ্যতা ও ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে প্রান্তিক মানুষের মতামতের ভিত্তিতে পাওয়া সুপারিশ তুলে ধরা হয়।