ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পুরোনো বিরোধে রাজনৈতিক রং

পুরোনো বিরোধে রাজনৈতিক রং

ফাইল ছবি

সাহাদাত হোসেন পরশ ও বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৪:১২ | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ০৪:১৩

জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে এরই মধ্যে গঠন হয়েছে নতুন সরকার। তবে জেলায় জেলায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতে ঝরছে প্রাণ। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগে গৃহদাহ শুরু হয়েছে। হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। কিছু এলাকায় পুরোনো বিরোধকে কাজে লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। জমিজমা, আর্থিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ক্ষোভকে রাজনৈতিক রং দেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাতে এরই মধ্যে ছয়জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন চার শতাধিক। ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ৩৯টি জেলায় ছোট-বড় হামলা ও পাল্টা হামলা হয়েছে। অনেক স্থানে হামলার ভয়ে কেউ কেউ বাড়িছাড়া। অধিকাংশ জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘাতে জড়াচ্ছে। তবে অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের পদধারী। 

নির্বাচনের পর মাঠে আওয়ামী লীগের দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের বিরোধ মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ের সব নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচন ঘিরে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা নিরসন করা না গেলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ মাঠ পর্যায়ে যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর সুযোগ নেবে বিরোধীরা।

পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত কঠোরভাবে মোকাবিলা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 
কোনো জায়গায় সংঘর্ষ হলেই মামলা ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরোনো বিরোধকে এখন কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ; যা নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। মুন্সীগঞ্জেও এই ধরনের নজির দেখেছি। সেখানে একজন মারা গেছেন। ওই হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কোনো বিষয় নেই। এমন কিছু জায়গায় ঘটনা ঘটছে, যেখানে প্রার্থীদের কোনো পক্ষই জানে না– কী বিরোধে ঘটনার সূত্রপাত। পুরোনো শত্রুতাকে কেউ কেউ রাজনৈতিক মাঠে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করছে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, নৌকার প্রার্থী কিংবা স্বতন্ত্র যিনি জিতেছেন, তাঁর দায়-দায়িত্ব বেশি। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর নেতাকর্মীকে শান্ত থাকতে বলবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সবার এমপি। সাবেক আইজিপি আরও বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ যাতে কোনো পক্ষ না নেয়।

একাধিক জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা সংঘাত-সহিংসতা ঘটাতে পারে, তাদের তালিকা তৈরি করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কেউ কেউ সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে তৃণমূলে যাতে সংঘাত ছড়িয়ে না পড়ে, সেটি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটিয়ে এলাকায় নতুনভাবে আধিপত্য ও প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করছেন কিনা, সেদিকেও নজর রাখছে প্রশাসন।

হতদরিদ্র জিয়ার হোসেন নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৪ আসনে (কুমারখালী এলাকা) নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচন শেষ হলেও শুরু হয়েছে জিয়ার হোসেনের পরিবারের আর্তনাদ। একদিকে স্বামী হারানো শোক, অন্যদিকে অর্থকষ্ট– অথৈ সাগরে পড়েছেন স্ত্রী রিনা খাতুন। সম্পত্তি বলতে নদীর পাড়ে দেড় কাঠা ভিটে জমি। এটিই সম্বল তাঁর। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় জিয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর পরিবারের। শুধু কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জেলে জিয়ার হোসেন নন; নির্বাচনী সহিংসতায় সারাদেশে ছয়জন নিহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মূলত যেসব আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে এবং উভয় প্রার্থী প্রভাবশালী, সেসব এলাকায় সংঘর্ষ বেশি হয়েছে।

মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় সারাদেশে চার শতাধিক ব্যক্তি আহত, ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, তিন শতাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ভোটার ভোট প্রদান করেননি– এমন কিছু মানুষের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। দেশের ৩৯টি জেলার জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর নেতাকর্মী কিংবা সমর্থকের মধ্যে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহে অন্তত ৫০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়িতে ৫০টি, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টির অধিক দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নোয়াখালী, নেত্রকোনা, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ, পটুয়াখালী, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ঘটে।

কুষ্টিয়া-৪ আসনে জিয়ার হোসেনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত আবদুর রউফ এমপির সমর্থকদের বিরুদ্ধে। জিয়ার হোসেনের আরেক ভাই আলতাফ হোসেনের পা ভেঙে দেয় হামলাকারীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুর রউফের কাছে পরাজিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ।

ইয়ারুল নামের একজন জানান, ১২ জানুয়ারি রিপনসহ তাঁর লোকজন জিয়ার হোসেন ও আলতাফ হোসেনের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে জিয়ারকে গুলি করে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় জিয়ার ও আলতাফকে ঢাকায় জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ জানুয়ারি জিয়ারের মৃত্যু হয়। আলতাফ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন।

নোয়াখালী-২ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মোর্শেদ আলম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি স্বতন্ত্র আতাউর রহমান ভুঁইয়া। ভোটকেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমানের এজেন্ট ও স্থানীয় যুবলীগ কর্মী শহিদুজ্জামান ওরফে পলাশের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এর জেরে ১৩ জানুয়ারি সোনাইমুড়ী উপজেলার পূর্ব মির্জানগর গ্রামে শহিদুজ্জামানকে গুলি করে ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলিয়ে খুন করা হয়। স্বতন্ত্র আতাউর রহমানের দাবি, পূর্ব মির্জানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোর্শেদ আলমের সমর্থকরা নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করলে শহিদুজ্জামান প্রতিবাদ করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। 

সোনাইমুড়ী থানার ওসি বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলমান। সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় ইমারত সরদার নামের এক ব্যক্তি খুন হন। তিনি নবনির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগমের কর্মী। ৮ জানুয়ারি হামলার ঘটনা ঘটে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইমারত প্রাণ হারান। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, নির্বাচনের পরদিন সকালে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ফাসিয়াতলা বাজারে বিজয়ী প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থকরা আনন্দ উল্লাস করছিল। এ সময় নৌকার সমর্থকরা ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে ইমারতসহ ছয়জন আহত হন। ইমারতের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১০ জানুয়ারি সেখানে প্রাণ হারান তিনি। মাদারীপুর-৩ আসনে তাহমিনা বেগমের কাছে পরাজিত হন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ। হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ড ছাড়াও মাদারীপুর-৩ আসনে নির্বাচন-পরবর্তী ছয়টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় তাহমিনা বেগমের সমর্থকরা সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান সেলিমের বাড়িতে হামলা চালায়। এ ছাড়া আন্ডারচর গ্রাম, সাহেবরামপুর বাজার এবং চরসাহেবরামপুর লঞ্চঘাট এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাহমিনার সমর্থকরা। সাহেবরামপুর বাজারে নৌকা সমর্থকদের অন্তত ১০টি দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে কয়ারিয়া ইউনিয়নের চরআলিমাবাদ এলাকায় তাহমিনা বেগমের সমর্থনকারীরা নৌকা প্রতীকের সমর্থক বাদশা ফকিরের বাড়িতে হামলা চালায়। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলা ও খুনের ঘটনায় মোট সাতটি মামলা হয়েছে।

নেত্রকোনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অসীম কুমার উকিল পরাজিত হয়েছেন। এ আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার। ৭ জানুয়ারি রাতে দেওগাঁও এলাকায় বিজয় মিছিল বের করেন ইফতিকার উদ্দিন তালুকদারের লোকজন। এ সময় নৌকার প্রার্থীর লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। লুনেশ্বর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। হামলায় নবনির্বাচিত এমপি ইফতিকার উদ্দিনের সমর্থক নুরুল আমিনসহ ১২ জন আহত হন। নুরুল আমিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর। তিনি পেশায় কৃষক। তাঁর বাড়ি দেওগাঁও গ্রামে। হত্যা মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে (সিরাজদিখান-শ্রীনগর) চিত্রকোট ইউনিয়নের খালপাড় এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবিরের সমর্থক নয়ন মিয়ার হাতের কবজি কেটে ফেলেছে নৌকার সমর্থকরা। নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদ এমপি নির্বাচিত হন। ৮ জানুয়ারি নৌকার বিজয় মিছিল করে স্থানীয় নেতাকর্মী। এ সময় নৌকার সমর্থক জয়নাল ও তাঁর ছেলে ফাহাদসহ নয়নের ওপর হামলা চালায় এবং তাঁর একটি হাতের কবজি কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×