- রাজনীতি
- ঢাকা দক্ষিণে আ'লীগ এখন দুই ছেলের 'হাতের মোয়া'
ঢাকা দক্ষিণে আ'লীগ এখন দুই ছেলের 'হাতের মোয়া'

রাজধানীর কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের অনুমতির জন্য গত বছর আগস্টে ওই ইউনিটের নেতারা গিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর কাছে। তিনি নেতাদের কথা শুনে বিষয়টি নিয়ে তার ছেলে আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরবের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। গৌরব দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। কিন্তু নেতারা গৌরবের সঙ্গে কথা বলতে যাননি। আর গত ছয় মাসে মেলেনি সম্মেলনের অনুমতিও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, মন্নাফী সভাপতি হলেও তার ছেলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। দলের ভার অলিখিতভাবে গৌরবকেই দিয়ে রেখেছেন তিনি।
একই অভিযোগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের বিরদ্ধেও। নেতাকর্মীরা বলছেন, পদ-পদায়ন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার ছেলে রেজাউল কবির রকি। তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুই ছেলে এরই মধ্যে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছেন বলয়। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন দলীয় সব কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি অপরাধ জগতেও প্রতিষ্ঠা করেছেন কর্তৃত্ব। সমকালের পক্ষ থেকে বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রাডো ৩০ বছর ধরে ওই থানার বিভিন্ন ইউনিট ও ওয়ার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। তার অভিযোগ, নগর নেতৃত্ব তাকে এখন পাত্তাই দেয় না। তার থানা ও ওয়ার্ডের কর্মসূচিতে তার নাম থাকে না। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট সম্মেলনের দাওয়াতপত্রে সভাপতি হিসেবে তার নাম দেওয়া হয়নি। দলের সদস্য সংগ্রহের ফরমের বই চাইলেও তাকে দেওয়া হয়নি।
রাডো সমকালকে বলেন, 'সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ছেলে এখন দল চালায়। এজন্য তারা আমার মতো পুরোনোদের ডাকে না। বিষয়টি নিয়ে নগরের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও বলেছেন, ওই এলাকা (চকবাজার) সাধারণ সম্পাদকের। তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।'
চারটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাদের কিছু না জানিয়েই দলের নামে নানা কর্মসূচি ও অনুষ্ঠান হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানা আর ওয়ার্ডের পদধারী নেতাদের না জানিয়েই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুই ছেলের অনুসারীরা কর্মসূচি পালন করে। সামনের সারিতে থাকে চিহ্নিত চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, মাদক মামলার আসামিসহ বিতর্কিত ব্যক্তিরা। ১২ জানুয়ারি ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট সম্মেলনে বিতর্কিতদের দেখে অতিথি হয়ে আসা কেন্দ্রীয় নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে দলের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমে গৌরব ও রকির অনুসারীরা ভিন্ন দলের কর্মী থেকে শুরু করে মামলার আসামি ও বিতর্কিতদের দলে ঢুকিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছেন। তারাই দখল, চাঁদাবাজি, ভবন নিয়ন্ত্রণ, পরিবহনের চাঁদাবাজি ও মাদকের নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্ম করে চলেছেন। সুবিধাভোগী কিছু নেতা তাদের সহায়তা দিচ্ছেন। ভুক্তভোগী সাধারণ লোক তো দূরের কথা, পদধারীরাও অপদস্থ হওয়ার ভয়ে এসব নিয়ে মুখ খোলেন না।
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দুটি থানার পদধারী চার নেতা জানান, আবু আহমেদ মন্নাফী নগর দক্ষিণের সহসভাপতি থাকার সময় কোনো দিন রাজনীতি না করা ছেলে গৌরবকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক বানান। এরপর গৌরব কাউন্সিলর হলে এলাকার রাজনীতির পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। তার সম্মতি ছাড়া কোনো ইউনিট বা ওয়ার্ডের কমিটিতে পদ পাওয়া যায় না। তার বলয়ে থাকা লোকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং নানা অপরাধে যুক্ত।
অবশ্য ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। দলের সব কার্যক্রম তিনি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরসহ মহানগর নেতারাই চালাচ্ছেন।
মন্নাফীর ভাষ্য, তার ছেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে কাজকর্ম নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে। সে কীভাবে মহানগর আওয়ামী লীগকে চালাবে? নগরের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের সময় তার কোথায়? তাছাড়া তার কথা মহানগর, থানা বা ওয়ার্ড নেতাকর্মীরা কেনই বা মানতে যাবেন?
প্রবীণ এই নেতার দাবি, 'এগুলো আসলে শত্রুতা। যারা বিভিন্ন পদ-পদবি বা সুবিধার জন্য দলের কাছে আসেন, কিন্তু পান না, তারাই এগুলো বলে অহেতুক মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।'
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী থেকে ওয়ার্ড, থানা ও মহানগরের নেতৃত্ব দিয়ে এখন দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই পর্যায়ে এসে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চালাতে কি তার ছেলের সহযোগিতা নিতে হবে? যে ছেলের জন্মই হলো সেদিন!
তিনি বলেন, 'রকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাজনীতিতে নজর দেওয়ার সময় তার কোথায়? কাজেই এসব বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে মানুষের মধ্যে দল সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই হবে না।'
গৌরব আর রকির অফিস :বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আনুষ্ঠানিক দপ্তর। তবে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর অভিযোগ, সেখান থেকে এখন আর কর্মসূচি প্রণয়ন হয় না। প্রায় সবকিছুই হয় রাজধানীর কাপ্তানবাজরে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অফিস থেকে। গৌরবের এই অফিসেই প্রতি রাতে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতারা ভিড় করেন।
সরেজমিন ঘুরেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, মধ্যরাত পর্যন্ত ওই অফিসে চলে নানা দেনদরবার। মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ওয়ারী, সূত্রাপুর, কোতোয়ালির একাংশ, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানার দলীয় কার্যক্রম চলে এই অফিস ঘিরেই।
নবাবপুর মোড় থেকে হোটেল সুপার স্টার পর্যন্ত প্রতি রাতে অবৈধভাবে মুরগির পাইকারি দোকান বসিয়েছেন গৌরব। প্রতি রাতে গৌরবের অন্তত ৭০ জন অনুসারী মুরগিবাহী শত শত গাড়ি থেকে টাকা আদায় করেন। মো. রাসেল নামে এক ব্যক্তি এতে নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজেকে গৌরবের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুরগি বিক্রেতার গাড়ি থেকে ১৫০০ টাকা এবং ক্রেতার গাড়ি থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। প্রতি রাতে চাঁদা ওঠে কয়েক লাখ টাকা। এ ছাড়া গুলিস্তান, ওয়ারী, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহনে চাঁদার ভাগও পান গৌরব। মেডি নামে এক ব্যক্তি তার আর্থিক বিষয় দেখভাল করেন।
তবে আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি তার বাবার সুরেই সমকালকে বলেন, 'ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে আমার বেশিরভাগ সময় সিটি করপোরেশনের কাজে ব্যয় হয়। এই অবস্থায় মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি আমার মাধ্যমে চলবে- এটা কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া আমি কি আমার বাবাকে (আবু আহমেদ মন্নাফী) অসম্মান করব? আমি রাজনীতির বুঝিটা কী?'
দলের মধ্যে আলাদা বলয় তৈরির বিষয়ে গৌরবের ভাষ্য, তিনি ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যে সাংগঠনিক দায়িত্বগুলো পালনের কথা, সেটাই পালন করছেন। আলাদা বলয় তৈরির অভিযোগ অবান্তর।
মুরগির বাজার ও চাঁদাবাজির বিষয়ে গৌরব বলেন, মুরগির বাজার তার কার্যালয়ের সামনে হলে তিনি কী করতে পারেন? এমন নয় যে, তিনি কাউন্সিলর হওয়ার পর বাজারটি হয়েছে। আর রাসেল তার চাচাতো ভাই হলেও তার মাধ্যমে মুরগির বাজারের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও সম্পূর্ণ মিথ্যা।
অপরদিকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, বংশালসহ ওই এলাকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলে সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ছেলে রেজাউল কবির রকির অফিস থেকে। তিনি অফিস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটে।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রকির হয়ে চকবাজারের ২৭, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা দেখভাল করেন শাহীন আলম খান নামে এক ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও তাকে চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ দেওয়া হবে বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচার রয়েছে।
চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, শাহীন নগর সাধারণ সম্পাদক ও তার ছেলের পরিচয়ে সব ধরনের কাজ করেন। পুরো চকবাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহীন খানের হয়ে মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ তার খালাতো ভাই রুবেলের হাতে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক হত্যা ও মাদকের মামলা। তার গ্রুপ ইসলামবাগে প্লাস্টিকের কারখানায় চাঁদাবাজি, সরকারি জায়গা দখল করে রিকশা গ্যারেজ তৈরি করে টাকা আদায় করে আসছে। এ ছাড়া এই গ্রুপে নজু, দেলোয়ার, হাজি রহিম, আক্কাস নানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা প্লাস্টিক তৈরির কারখানাগুলোর বোলিং মেশিন থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করছে। ওমর ফারুক নামে একজন চকবাজারের নকল কসমেটিকসের নিয়ন্ত্রণ করেন। মৌলভীবাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক বখতিয়ার নামের একজন।
এসব নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে কয়েকজন ওয়ার্ড নেতা লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের অনুসারীরা এলাকার সব বাজার, ফুটপাত ও ছুটির দিনের মার্কেট, দোকান, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা তোলেন। এ ছাড়া গণপূর্তের আজিমপুর বিভাগ, আজিমপুর মেটারনিটিসহ বিভিন্ন ভবনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।
নেতাদের অভিযোগ, লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান জামাল আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, লেডিস ক্লাব ও কলোনির ভেতর মার্কেট ও স্থাপনা দখল ও ভাড়া আদায় করছেন। ওই এলাকার সব অনিয়ম ও অপকর্ম হয় জামালকে ঘিরে। তিনিও হুমায়ুন কবির ও তার ছেলের পরিচয়ে এসব অপকর্ম করছেন।
লিখিত অভিযোগ দেওয়া এসব নেতার সঙ্গে সমকালের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলেছেন, তাদের অভিযোগ লিখিতভাবে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতাদের জানিয়েছেন। নতুন করে এ নিয়ে কিছু বলতে চান না।
আর রেজাউল কবির রকি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এগুলো আসলে একশ্রেণির লোক হিংসা ও শত্রুতার জন্য ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এলাকায় খোঁজখবর নিলেও পাওয়া যাবে, তারা কোন মানসিকতা ও সংস্কৃতির লোক।
তার দাবি, শাহীন আলম খান নামে কাউকে চেনেন না। তাই তাকে দিয়ে সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নও আসে না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নগর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, এমন অভিযোগ যদি কেউ দিয়েও থাকেন, তাহলে সেটা সঠিক নয়। কেননা মহানগরের সবাইকে নিয়েই দলের কার্যক্রম চালান তিনি। এলাকার সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। সেখানে কাউকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বা হয়েছে- এমন অভিযোগ একেবারেই অবান্তর।
সার্চ কমিটিতে ভিন্ন দলের লোক :গত বছরের ৭ নভেম্বর লালবাগ কমিউনিটি সেন্টারে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সার্চ কমিটি হয়। সেখানে তালিকায় বিএনপি নেতার নাম দেখে খেপে যান ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরাম উল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। তিনি মাইক নিয়ে বলতে থাকেন, 'মোল্লা গাফফারকে সার্চ কমিটিতে রাখা যাবে না। কারণ সে বিএনপির ক্যাডার। সার্চ কমিটিতে থাকা আলী আকবর তারেক জিয়া মুক্তি পরিষদের লালবাগ শাখার আহ্বায়ক। আলমগীরও সার্চ কমিটিতে, তার বিরুদ্ধে জাল টাকা ও মাদকের মামলা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী হত্যা মামলার আসামি সে।' ওয়ার্ড সভাপতির এমন হৈচৈর পর উল্টো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন সেখানে উপস্থিত নগর সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা।
ইকরাম উল্লাহ সোহরাওয়ার্দী সমকালকে বলেন, 'দলের মধ্যে এমন অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারিনি।' তিনি বলেন, সার্চ কমিটিতে থাকা লোকজনই একদিন আওয়ামী লীগের পদে আসবেন। টাকার বিনিময়ে এরা ভিন্ন দল থেকে এখানে আসছেন। দলের কিছু নেতা নিজের গ্রুপ ভারী করতে অপরাধীদের সার্চ কমিটিতে ঢুকিয়েছেন।
দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া খালিদের সহযোগী নুরুন্নবী ভূইয়া রাজু ও খালিদের ডান হাত হিসেবে পরিচিত অঙ্কুরকে ঢোকানো হয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে মাদক ব্যবসায়ী সাধু, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসা পল্টনের পপির সহযোগী শরীফ, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিরক, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মাদক ব্যবসায়ী নাসির ও সাকিল এবং ফকিরাপুলের খোকনকে রাখা হয়েছে। এই খোকনের বাসা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এরা সবাই এখন নগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
লালবাগ থানা তারেক জিয়া মুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক আকবর আহমেদ, অস্ত্র মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল গাফফার, মাদক কারবারি মহসিন আজাদ, মাদক মামলার আসামি সাজেদ খান জনি, কালু মিয়া, ছাত্রদলের নেতা ইউসুফ, বিএনপিকর্মী আব্দুল আলিম, জাল টাকার মামলার আসামি আলমগীর, রিকশা চুরি মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন, যুবদল নেতা নাদিমসহ অনেকের নাম রয়েছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সার্চ কমিটিতে। এই ব্যক্তিরা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তার ছেলের অনুসারী বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে গৌরব বলেন, সার্চ কমিটিগুলো থানা-ওয়ার্ডের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি কোনোভাবেই এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাছাড়া সার্চ কমিটিগুলো হয়েছিল ছয়-সাত মাস আগে। এতদিন পর এই অভিযোগ কেন আসছে?
আর রেজাউল কবির রকি বলেন, তিনি যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক, মহানগর আওয়ামী লীগের কেউ নন। এই অবস্থায় সদস্য সংগ্রহ বা সার্চ কমিটি কিংবা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কোথায় তার? যুবলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে তাকে সিলেট বিভাগে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি সেটা নিয়েই থাকতে চান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, মন্নাফী সভাপতি হলেও তার ছেলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। দলের ভার অলিখিতভাবে গৌরবকেই দিয়ে রেখেছেন তিনি।
একই অভিযোগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের বিরদ্ধেও। নেতাকর্মীরা বলছেন, পদ-পদায়ন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার ছেলে রেজাউল কবির রকি। তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুই ছেলে এরই মধ্যে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছেন বলয়। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন দলীয় সব কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি অপরাধ জগতেও প্রতিষ্ঠা করেছেন কর্তৃত্ব। সমকালের পক্ষ থেকে বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রাডো ৩০ বছর ধরে ওই থানার বিভিন্ন ইউনিট ও ওয়ার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। তার অভিযোগ, নগর নেতৃত্ব তাকে এখন পাত্তাই দেয় না। তার থানা ও ওয়ার্ডের কর্মসূচিতে তার নাম থাকে না। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট সম্মেলনের দাওয়াতপত্রে সভাপতি হিসেবে তার নাম দেওয়া হয়নি। দলের সদস্য সংগ্রহের ফরমের বই চাইলেও তাকে দেওয়া হয়নি।
রাডো সমকালকে বলেন, 'সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ছেলে এখন দল চালায়। এজন্য তারা আমার মতো পুরোনোদের ডাকে না। বিষয়টি নিয়ে নগরের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও বলেছেন, ওই এলাকা (চকবাজার) সাধারণ সম্পাদকের। তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।'
চারটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাদের কিছু না জানিয়েই দলের নামে নানা কর্মসূচি ও অনুষ্ঠান হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানা আর ওয়ার্ডের পদধারী নেতাদের না জানিয়েই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুই ছেলের অনুসারীরা কর্মসূচি পালন করে। সামনের সারিতে থাকে চিহ্নিত চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, মাদক মামলার আসামিসহ বিতর্কিত ব্যক্তিরা। ১২ জানুয়ারি ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট সম্মেলনে বিতর্কিতদের দেখে অতিথি হয়ে আসা কেন্দ্রীয় নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে দলের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমে গৌরব ও রকির অনুসারীরা ভিন্ন দলের কর্মী থেকে শুরু করে মামলার আসামি ও বিতর্কিতদের দলে ঢুকিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছেন। তারাই দখল, চাঁদাবাজি, ভবন নিয়ন্ত্রণ, পরিবহনের চাঁদাবাজি ও মাদকের নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্ম করে চলেছেন। সুবিধাভোগী কিছু নেতা তাদের সহায়তা দিচ্ছেন। ভুক্তভোগী সাধারণ লোক তো দূরের কথা, পদধারীরাও অপদস্থ হওয়ার ভয়ে এসব নিয়ে মুখ খোলেন না।
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দুটি থানার পদধারী চার নেতা জানান, আবু আহমেদ মন্নাফী নগর দক্ষিণের সহসভাপতি থাকার সময় কোনো দিন রাজনীতি না করা ছেলে গৌরবকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক বানান। এরপর গৌরব কাউন্সিলর হলে এলাকার রাজনীতির পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। তার সম্মতি ছাড়া কোনো ইউনিট বা ওয়ার্ডের কমিটিতে পদ পাওয়া যায় না। তার বলয়ে থাকা লোকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং নানা অপরাধে যুক্ত।
অবশ্য ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। দলের সব কার্যক্রম তিনি, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরসহ মহানগর নেতারাই চালাচ্ছেন।
মন্নাফীর ভাষ্য, তার ছেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে কাজকর্ম নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে। সে কীভাবে মহানগর আওয়ামী লীগকে চালাবে? নগরের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের সময় তার কোথায়? তাছাড়া তার কথা মহানগর, থানা বা ওয়ার্ড নেতাকর্মীরা কেনই বা মানতে যাবেন?
প্রবীণ এই নেতার দাবি, 'এগুলো আসলে শত্রুতা। যারা বিভিন্ন পদ-পদবি বা সুবিধার জন্য দলের কাছে আসেন, কিন্তু পান না, তারাই এগুলো বলে অহেতুক মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।'
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী থেকে ওয়ার্ড, থানা ও মহানগরের নেতৃত্ব দিয়ে এখন দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই পর্যায়ে এসে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চালাতে কি তার ছেলের সহযোগিতা নিতে হবে? যে ছেলের জন্মই হলো সেদিন!
তিনি বলেন, 'রকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাজনীতিতে নজর দেওয়ার সময় তার কোথায়? কাজেই এসব বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে মানুষের মধ্যে দল সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই হবে না।'
গৌরব আর রকির অফিস :বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবনেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আনুষ্ঠানিক দপ্তর। তবে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর অভিযোগ, সেখান থেকে এখন আর কর্মসূচি প্রণয়ন হয় না। প্রায় সবকিছুই হয় রাজধানীর কাপ্তানবাজরে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অফিস থেকে। গৌরবের এই অফিসেই প্রতি রাতে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতারা ভিড় করেন।
সরেজমিন ঘুরেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, মধ্যরাত পর্যন্ত ওই অফিসে চলে নানা দেনদরবার। মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ওয়ারী, সূত্রাপুর, কোতোয়ালির একাংশ, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানার দলীয় কার্যক্রম চলে এই অফিস ঘিরেই।
নবাবপুর মোড় থেকে হোটেল সুপার স্টার পর্যন্ত প্রতি রাতে অবৈধভাবে মুরগির পাইকারি দোকান বসিয়েছেন গৌরব। প্রতি রাতে গৌরবের অন্তত ৭০ জন অনুসারী মুরগিবাহী শত শত গাড়ি থেকে টাকা আদায় করেন। মো. রাসেল নামে এক ব্যক্তি এতে নেতৃত্ব দেন। তিনি নিজেকে গৌরবের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুরগি বিক্রেতার গাড়ি থেকে ১৫০০ টাকা এবং ক্রেতার গাড়ি থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। প্রতি রাতে চাঁদা ওঠে কয়েক লাখ টাকা। এ ছাড়া গুলিস্তান, ওয়ারী, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহনে চাঁদার ভাগও পান গৌরব। মেডি নামে এক ব্যক্তি তার আর্থিক বিষয় দেখভাল করেন।
তবে আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি তার বাবার সুরেই সমকালকে বলেন, 'ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে আমার বেশিরভাগ সময় সিটি করপোরেশনের কাজে ব্যয় হয়। এই অবস্থায় মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি আমার মাধ্যমে চলবে- এটা কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া আমি কি আমার বাবাকে (আবু আহমেদ মন্নাফী) অসম্মান করব? আমি রাজনীতির বুঝিটা কী?'
দলের মধ্যে আলাদা বলয় তৈরির বিষয়ে গৌরবের ভাষ্য, তিনি ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যে সাংগঠনিক দায়িত্বগুলো পালনের কথা, সেটাই পালন করছেন। আলাদা বলয় তৈরির অভিযোগ অবান্তর।
মুরগির বাজার ও চাঁদাবাজির বিষয়ে গৌরব বলেন, মুরগির বাজার তার কার্যালয়ের সামনে হলে তিনি কী করতে পারেন? এমন নয় যে, তিনি কাউন্সিলর হওয়ার পর বাজারটি হয়েছে। আর রাসেল তার চাচাতো ভাই হলেও তার মাধ্যমে মুরগির বাজারের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও সম্পূর্ণ মিথ্যা।
অপরদিকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, বংশালসহ ওই এলাকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলে সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের ছেলে রেজাউল কবির রকির অফিস থেকে। তিনি অফিস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটে।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রকির হয়ে চকবাজারের ২৭, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা দেখভাল করেন শাহীন আলম খান নামে এক ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও তাকে চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ দেওয়া হবে বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচার রয়েছে।
চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, শাহীন নগর সাধারণ সম্পাদক ও তার ছেলের পরিচয়ে সব ধরনের কাজ করেন। পুরো চকবাজার এলাকার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহীন খানের হয়ে মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ তার খালাতো ভাই রুবেলের হাতে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক হত্যা ও মাদকের মামলা। তার গ্রুপ ইসলামবাগে প্লাস্টিকের কারখানায় চাঁদাবাজি, সরকারি জায়গা দখল করে রিকশা গ্যারেজ তৈরি করে টাকা আদায় করে আসছে। এ ছাড়া এই গ্রুপে নজু, দেলোয়ার, হাজি রহিম, আক্কাস নানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা প্লাস্টিক তৈরির কারখানাগুলোর বোলিং মেশিন থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করছে। ওমর ফারুক নামে একজন চকবাজারের নকল কসমেটিকসের নিয়ন্ত্রণ করেন। মৌলভীবাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক বখতিয়ার নামের একজন।
এসব নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে কয়েকজন ওয়ার্ড নেতা লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের অনুসারীরা এলাকার সব বাজার, ফুটপাত ও ছুটির দিনের মার্কেট, দোকান, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা তোলেন। এ ছাড়া গণপূর্তের আজিমপুর বিভাগ, আজিমপুর মেটারনিটিসহ বিভিন্ন ভবনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।
নেতাদের অভিযোগ, লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান জামাল আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, লেডিস ক্লাব ও কলোনির ভেতর মার্কেট ও স্থাপনা দখল ও ভাড়া আদায় করছেন। ওই এলাকার সব অনিয়ম ও অপকর্ম হয় জামালকে ঘিরে। তিনিও হুমায়ুন কবির ও তার ছেলের পরিচয়ে এসব অপকর্ম করছেন।
লিখিত অভিযোগ দেওয়া এসব নেতার সঙ্গে সমকালের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলেছেন, তাদের অভিযোগ লিখিতভাবে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতাদের জানিয়েছেন। নতুন করে এ নিয়ে কিছু বলতে চান না।
আর রেজাউল কবির রকি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এগুলো আসলে একশ্রেণির লোক হিংসা ও শত্রুতার জন্য ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এলাকায় খোঁজখবর নিলেও পাওয়া যাবে, তারা কোন মানসিকতা ও সংস্কৃতির লোক।
তার দাবি, শাহীন আলম খান নামে কাউকে চেনেন না। তাই তাকে দিয়ে সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নও আসে না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নগর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, এমন অভিযোগ যদি কেউ দিয়েও থাকেন, তাহলে সেটা সঠিক নয়। কেননা মহানগরের সবাইকে নিয়েই দলের কার্যক্রম চালান তিনি। এলাকার সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়েও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। সেখানে কাউকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বা হয়েছে- এমন অভিযোগ একেবারেই অবান্তর।
সার্চ কমিটিতে ভিন্ন দলের লোক :গত বছরের ৭ নভেম্বর লালবাগ কমিউনিটি সেন্টারে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সার্চ কমিটি হয়। সেখানে তালিকায় বিএনপি নেতার নাম দেখে খেপে যান ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরাম উল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। তিনি মাইক নিয়ে বলতে থাকেন, 'মোল্লা গাফফারকে সার্চ কমিটিতে রাখা যাবে না। কারণ সে বিএনপির ক্যাডার। সার্চ কমিটিতে থাকা আলী আকবর তারেক জিয়া মুক্তি পরিষদের লালবাগ শাখার আহ্বায়ক। আলমগীরও সার্চ কমিটিতে, তার বিরুদ্ধে জাল টাকা ও মাদকের মামলা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী হত্যা মামলার আসামি সে।' ওয়ার্ড সভাপতির এমন হৈচৈর পর উল্টো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন সেখানে উপস্থিত নগর সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা।
ইকরাম উল্লাহ সোহরাওয়ার্দী সমকালকে বলেন, 'দলের মধ্যে এমন অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারিনি।' তিনি বলেন, সার্চ কমিটিতে থাকা লোকজনই একদিন আওয়ামী লীগের পদে আসবেন। টাকার বিনিময়ে এরা ভিন্ন দল থেকে এখানে আসছেন। দলের কিছু নেতা নিজের গ্রুপ ভারী করতে অপরাধীদের সার্চ কমিটিতে ঢুকিয়েছেন।
দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া খালিদের সহযোগী নুরুন্নবী ভূইয়া রাজু ও খালিদের ডান হাত হিসেবে পরিচিত অঙ্কুরকে ঢোকানো হয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে মাদক ব্যবসায়ী সাধু, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসা পল্টনের পপির সহযোগী শরীফ, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিরক, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মাদক ব্যবসায়ী নাসির ও সাকিল এবং ফকিরাপুলের খোকনকে রাখা হয়েছে। এই খোকনের বাসা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এরা সবাই এখন নগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
লালবাগ থানা তারেক জিয়া মুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক আকবর আহমেদ, অস্ত্র মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল গাফফার, মাদক কারবারি মহসিন আজাদ, মাদক মামলার আসামি সাজেদ খান জনি, কালু মিয়া, ছাত্রদলের নেতা ইউসুফ, বিএনপিকর্মী আব্দুল আলিম, জাল টাকার মামলার আসামি আলমগীর, রিকশা চুরি মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন, যুবদল নেতা নাদিমসহ অনেকের নাম রয়েছে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সার্চ কমিটিতে। এই ব্যক্তিরা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তার ছেলের অনুসারী বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফীর ছেলে গৌরব বলেন, সার্চ কমিটিগুলো থানা-ওয়ার্ডের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি কোনোভাবেই এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাছাড়া সার্চ কমিটিগুলো হয়েছিল ছয়-সাত মাস আগে। এতদিন পর এই অভিযোগ কেন আসছে?
আর রেজাউল কবির রকি বলেন, তিনি যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক, মহানগর আওয়ামী লীগের কেউ নন। এই অবস্থায় সদস্য সংগ্রহ বা সার্চ কমিটি কিংবা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কোথায় তার? যুবলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে তাকে সিলেট বিভাগে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি সেটা নিয়েই থাকতে চান।
মন্তব্য করুন