
আর কখনও সন্তানদের জড়িয়ে ধরে বলবেন না, 'হুমায়রা-হামিম, খেয়ে নাও।' চিরদিনের জন্য বাবার আদর থেকে বঞ্চিত ছোট দুই ভাইবোন। নিউমার্কেটের সংঘর্ষে আহত দোকান কর্মচারী মুরসালিন বৃহস্পতিবার হাসপাতালে মারা যান। তার পরিবারে চলছে মাতম - সাজ্জাদ নয়ন
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আর ব্যবসায়ীদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনায় রাত-দিনের সংঘাতে দু'জনের প্রাণহানি, শতাধিক লোক আহত আর 'শতকোটি' টাকার আর্থিক ক্ষতির পর প্রাণ ফিরেছে নিউমার্কেটসহ আশপাশের বিপণিবিতানে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে মার্কেটগুলোর দোকানিরা ফের বেচাকেনায় মেতেছেন। শান্তির বাতাস বইলেও দোকানকর্মীদের মনে এখনও অজানা ভীতি ভর করে আছে। আতঙ্কে গতকাল ওই এলাকায় ক্রেতার আনাগোনাও ছিল কম। এর আগে বুধবার রাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সমঝোতা বৈঠকে বসেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল। সেখানেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আশ্বাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমঝোতা হয়।
এদিকে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সংঘর্ষে হতাহত, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ম্ফোরণ ও পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় আলাদা তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৪০০ জনকে। এর মধ্যে পুলিশের ওপর হামলা মামলায় শুধু ২৪ আসামির নাম এজাহারে রয়েছে। এজাহারভুক্ত আসামির সবাই নিউমার্কেট থানা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষে গুরুতর আহত দোকানকর্মী মো. মুরসালিন মারা গেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ওই সংঘাতে এ নিয়ে দু'জনের মৃত্যু হলো। এর আগে মঙ্গলবার রাতে মারা যান পথচারী নাহিদ মিয়া। শতাধিক আহত হলেও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অন্তত ২০ জন। এর মধ্যে ঢাকা কলেজের ছাত্র মোশারফ হোসেনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।
গত সোমবার নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেট এলাকায় খাবারের দোকানের দুই কর্মীর দ্বন্দ্বের জেরে মারামারি হয়। পরে এক কর্মীর হয়ে ঢাকা কলেজের কয়েক শিক্ষার্থী সংঘাতে জড়ান। তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয় ছাত্ররা ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে গুজব ছড়ায় কেনাকাটা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হয়েছেন কয়েক শিক্ষার্থী। এ গুজবের ডালপালা ছড়ানোর পর চলতে থাকে সংঘর্ষ।
তিন মামলায় আসামি ১৪০০ :বুধবার গভীর রাতে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা তিনটি মামলার মধ্যে দুটিতে বাদী হয়েছে পুলিশ। অন্য মামলাটির বাদী হয়েছেন নিহত নাহিদের চাচা মো. সাইদ। হত্যাকাণ্ডের ধারায় দায়ের এই মামলায় অচেনা ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ঢাকা কলেজের ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের মুখে পড়ে তার ভাতিজা নাহিদ মিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে। কয়েকজন পথচারী তাকে হাসপাতালে নিলে মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যু হয়। পরে তিনি জানতে পারেন দেড়শ থেকে দুইশ ব্যক্তির আঘাতে তার ভাতিজা গুরুতর আহত হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এদিকে দায়িত্ব পালনের সময়ে পুলিশের কাজে বাধা, হামলা, ইটপাটকেল ছুড়ে জখম ও ভাঙচুরের অভিযোগে একটি মামলা করেন নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামীন কবীর। এজাহারে বলা হয়, অচেনা ২০০ থেকে ৩০০ ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারী এবং ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এক হয়ে ইটপাটকেল ছুড়ে। তখন ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। এই মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে ১২ জন এবং সরাসরি হামলায় জড়িত হিসেবে ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এজাহারভুক্ত ২৪ জনই নিউমার্কেট থানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পদধারী নেতা। তাদের অনেকে ওই মার্কেটে ব্যবসাও করেন না।
অপর মামলাটির বাদী হয়েছেন নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক মেহেদী হাসান। ককটেল বিস্ম্ফোরণ, সরকারি সম্পদ বিনষ্টসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগে ওই মামলায় অচেনা ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
পুলিশের নিউমার্কেট জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আসামিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এ কর্মকর্তা জানান, সংঘর্ষের ক্ষয়ক্ষতি ও দোকানকর্মী মুরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় আরও একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।
রাতভর বৈঠকে সমঝোতা :সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা সংঘর্ষের পর বুধবার রাতে সমঝোতা বৈঠকে বসেন ব্যবসায়ী নেতা এবং শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) সভাকক্ষে চলা ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ। এতে পুলিশের প্রতিনিধি ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন। ওই বৈঠকে সমঝোতায় পৌঁছায় সব পক্ষ।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী ও ছাত্র প্রতিনিধিরা জানান, সংঘর্ষের ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিতে সব পক্ষ ঐকমত্য পোষণ করেন। সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, সমঝোতা বৈঠকে ছাত্ররা কেনাকাটায় ডিসকাউন্ট পেতে পারেন, সে বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এতে জোরদবরদস্তির কোনো বিষয় থাকবে না। কেউ কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে ব্যবসায়ী ও কলেজ প্রশাসন সমন্বয় সেল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভা শেষে মাউশি মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ বলেন, সবাই ঐকমত্যে পৌঁছানোর ধারাবাহিকতায় মার্কেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ছাত্রদের ছুটি ও হলে থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্রদের দাবিগুলোর প্রায় সবই যৌক্তিক- এ কারণে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবিগুলো মানা হয়েছে।
আতঙ্কে উভয়পক্ষ :এদিকে গতকাল নিউমার্কেট এলাকায় সব মার্কেটই খুলেছে। দিনভর ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দোকানপাট খোলা হলেও ভিড় কম। তবে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হননি। পুরো এলাকাতেই মোতায়েন ছিল পুলিশ।
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও ঘটনার বিচার চান। তবে অচেনা আসামি থাকায় আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ ঘটনার সময়ে মারামারিতে না জড়ালেও তারা মার্কেটের ভেতরে ছিলেন।
প্রায় অভিন্ন ভাষ্য এসেছে ঢাকা কলেজের কয়েক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। তারা বলছেন, মামলায় অচেনা আসামি থাকায় পুলিশ হয়রানির সুযোগ পাবে।
তিন মামলার প্রতিবেদন দাখিল ৭ জুন : সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৭ জুন ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার এসব মামলার এজাহার আদালতে এলে ঢাকা মহানগর হাকিম শুভ্রা চক্রবর্তী নিউমার্কেট থানা পুলিশকে এই নির্দেশ দেন। মামলাগুলো হলো কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী নাহিদ হত্যা মামলা, পুলিশের ওপর হামলা মামলা ও বিস্ম্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা।
মন্তব্য করুন