
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থি-বামপন্থিদের জোট ১৪ দল ছেড়ে গেছে সম্প্রতি বাংলাদেশ জাসদ। এই দলের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ পথ হারিয়ে ফেলেছে। দলটি তার আগের আদর্শিক রাজনৈতিক ধারায়ও নেই। কাজেই এ দলের সঙ্গে থাকার আর কোনো সুযোগও নেই।' সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, '১৪ দল এখন চাটুকারদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে।' সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শরীফ নুরুল আম্বিয়া ১৪ দল ছাড়ার কারণ ও নতুন জোট গঠনের উদ্যোগের পাশাপাশি আগামী নির্বাচন ও চলমান রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমরেশ রায়
সমকাল: ১৪ দল ছাড়লেন কেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: ১৪ দল বর্তমানে একটা অকার্যকর জোটে পরিণত হয়েছে। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৪ দল গঠিত হয়েছিল, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তার কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি। আর সরকার যেভাবে লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও কর্তৃত্বপরায়ণতার মাধ্যমে দেশ চালাচ্ছে, সেটাও ১৪ দল ঘোষিত রাজনীতির সঙ্গে অসংগত। তা ছাড়া ১৪ দলে এখনও যারা আছে, তারা কেবল আওয়ামী লীগ ও সরকারের চাটুকারিতাই করে। এটা এখন চাটুকারদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। যেখানে অন্য কিছু বলার বা চর্চা করার কোনো সুযোগও নেই। স্বাভাবিকভাবে ১৪ দলের রাজনীতি কন্টিনিউ করার কোনো যুক্তি বা জায়গা আমরা খুঁজে পাইনি।
সমকাল: এটা কি ১৪ দল বা আওয়ামী লীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: যেসব কথা এখনই বললাম, করোনাকালে সেই কথাগুলোই টেলিফোনে ১৪ দলের সমন্বয়ককেও বলেছিলাম। এর পরও এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই ১৪ দল ছাড়ার বিষয়টি জোট বা আওয়ামী লীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর কোনো প্রয়োজন আমরা মনে করছি না।
সমকাল: ১৪ দলের ২৩ দফার মূল কথাই ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা। এই লক্ষ্য অর্জনে এখন আপনার দলের কৌশল কী হবে?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেই কাজটাই তো আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ পথ হারিয়ে ফেলেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, আওয়ামী লীগ আর তার সেই আদর্শিক রাজনৈতিক ধারায়ও নেই। কাজেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার কোনো সুযোগও আর নেই। তবে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণ অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে বা অন্য কোনো জোটে যুক্ত থেকেও করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ধারার দলগুলোকে নিয়ে নতুন আরেকটা গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জোট করার কথা বিবেচনায় নিয়েই আমরা এগোচ্ছি। এ লক্ষ্যে সংশ্নিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, গণফোরামের (একাংশ) সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে নতুন জোট করার বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে।
সমকাল: আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে আপনারা একাই নীরবে জোট ছাড়লেন। ১৪ দলের অন্য শরিকদের উদ্দেশে কী বলবেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: তাদের প্রতিও আমাদের একই বক্তব্য থাকবে, ১৪ দলের কার্যকারিতা আর নেই। তবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ইতিহাস ও পূর্ববর্তী ধারাবাহিকতা রয়েছে। দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা ও সবার মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও রয়েছে। সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই হয়তো বা ১৪ দলের বর্তমান শরিকরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
সমকাল: আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি দলের নেতৃত্বাধীন বড় জোট থেকে বের হয়ে এসে নতুন জোট করা কিংবা টিকে থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। তেমন রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য আপনাদের আছে বলে মনে করেন কি?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: দেখুন, কোনো দলের কোনো শক্তিই চূড়ান্ত কিছু নয়। জাসদ তো সবসময় চ্যালেঞ্জিং রাজনীতিই করে আসছে। এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো ক্ষমতাও আমাদের রয়েছে।
সমকাল: কিন্তু আপনারা নিজেরাই, অর্থাৎ জাসদই তো ঐক্যবদ্ধ নয়।
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, জাসদ অনেকভাবে বিভক্ত হয়েছে এবং বর্তমানেও জাসদের তিনটি অংশ সক্রিয় রয়েছে। তবে কথা হচ্ছে, বাহাত্তর সালে এই জাসদই কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধী দল ছিল। পরে জাসদ অনেকবার বিভক্ত হলেও মানুষের অধিকার আদায়ের সব লড়াই-সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও সামর্থ্যের পরিচয়ও দিতে পেরেছে। তা ছাড়া যে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির কথা বললাম, সেই পরিস্থিতিতে এককভাবে কোনো দলের কথা বলছি না, একটি বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মের উত্থানের কথাটাই বলছি। আমি মনে করি, দেশের মানুষও এটাতে সাড়া দেবে।
সমকাল: আগামী জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে কী ভাবছেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: আগামী নির্বাচন কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় করব, সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। এই মুহূর্তে দলের নিবন্ধনের বিষয়টাকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এ বিষয়ে আদালতের একটা অনুকূল রায়ও আমরা পেয়েছি। আমরা এটাকে পুরোপুরি সম্পন্ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আর নির্বাচনকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আরেকটা জোট করার প্রচেষ্টাও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।
সমকাল: আগামী নির্বাচনকে কেমন দেখতে চান?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: ২০১৮ সালের নির্বাচনটা যেভাবে হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আগামী নির্বাচনটা যেন মানুষ করতে পারে- সেই ধরনের নির্বাচনটাই প্রত্যাশা করি।
সমকাল: তার মানে, আগামী নির্বাচন নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া: সংশয়-শঙ্কা তো রয়েছেই। তবে ২০১৮ সালের মতো তথাকথিত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির কোনো সুযোগই আর নেই। এবার আর দিনের ভোট রাতে নয়, মানুষের ভোটে মানুষের নির্বাচনই হবে। সেটা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার, দেশের মানুষই তাই তাই করবে।
মন্তব্য করুন