
বিএনপি অফিসের সামনে নয়াপল্টন এলাকার সড়ক বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ সময় অন্যদের সঙ্গে আটকা পড়ে কর্মস্থলগামী মানুষ। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত -সমকাল
রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা নয়াপল্টন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ আর যানবাহনে গিজগিজ করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় আর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল ঘিরে লোকে লোকারণ্য নয়াপল্টন। এই এলাকাটিতেও নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবারের সকালটা ছিল অন্য রকম। এমন পরিবেশ এখানে বহু দিনে দেখেনি কেউ। কোলাহলময় নয়াপল্টন ছিল জনমানবহীন।
সকাল তখন সাড়ে ১১টা। কাকরাইলে স্কাউট ভবনের সামনের সড়কে উঁকিঝুঁকি মারছেন বেশ কয়েকজন। সেখানে কথা হয় সিরাজুর রহমান নামে এক যুবকের সঙ্গে। এখানে কী করেন- প্রশ্ন করতেই তাঁর মুখে রাজ্যের হতাশা। ফেনীর সোনাগাজীর বাসিন্দা সিরাজ ঢাকায় আসেন ২০ বছর আগে। নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের বিপরীত পাশে একটি চা দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের সংসার। তাঁরা থাকেন গ্রামে।
সিরাজ থাকেন নয়াপল্টনের বালুরমাঠ এলাকার একটি মেসে। বহু বছর এখানে থেকে চোখের সামনে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও দেখেছেন। সে সময়ের দুঃসহ স্মৃতি আবারও তাঁর মনে ভেসে উঠছে। আবারও রক্তাক্ত পরিবেশ দেখে আঁতকে উঠছেন তিনি। বুধবার বিএনপি কার্যালয় ঘিরে সহিংসতার পর থেকে তাঁর দোকান বন্ধ। দূর থেকে বারবার দৃষ্টি দিচ্ছেন উপার্জনের একমাত্র অবলম্বনের দিকে। কখন আবার খুলতে পারবেন দোকান- সেই আশায় আছেন। সিরাজ বলেন, করোনার ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এক মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এখনও শোধ করতে পারেননি। এভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।
সিরাজের মতো এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নয়াপল্টন এলাকার বহু বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী। রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বাসিন্দার উদ্বেগও প্রায় একই রকম। গতকাল দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বললে সবারই প্রশ্ন ছিল, কী হবে ১০ ডিসেম্বর? তাঁরা বলছেন, চারদিকে ভয়, কী জানি কী হয়।
এমনই ভয়ের রাজ্যে বাস করছেন বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতের বই দোকানি জহির উদ্দিন। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সময় সহিংসতায় তাঁর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আবার তিল তিল করে দোকান সাজিয়েছেন তিনি। করোনাকাল কাটিয়েছেন ধারদেনা করে। ময়মনসিংয়ের ঈশ্বরগঞ্জের বাসিন্দা জহিরের চোখেমুখে আবারও সব হারানোর ভয়।
১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজধানীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে বড় অরাজকতার শঙ্কা প্রকাশ করে জহির বলেন, 'ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। আগামী বছর নির্বাচন। এ রকম অস্থিরতা চলতে থাকলে পথে বসতে হবে।'
নাসরিন সুলতানা কলি স্বামী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটের পেছনে একটি বাসায়। তাঁর ছেলেমেয়ে কাকরাইলের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। তাঁদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। গতকাল ভেতরের একটি গলি দিয়ে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে গেছেন। স্কুলের ফটকে দাঁড়িয়ে নাসরিন বলেন, 'আমরা ভয় পাচ্ছি। ভয় ভাঙচুরের। ভয় আগুনে পুড়ে মানুষ মরার। বাসা থেকে বুধবার গুলির বিকট আওয়াজ পেয়েছি। দরজা-জানাল বন্ধ করে ঘরে বসেছিলাম।'
১০ ডিসেম্বর কী বড় রকম সহিংসতা হবে- নগরের মানুষের মুখে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। বড় দু'দল মুখোমুখি হবে কিনা, সংঘাতে আরও রক্ত ঝরবে কিনা সেই আলোচনা সর্বত্র। রাজধানীর মতিঝিলের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আলাউদ্দিন বলেন, 'আমাদের দুই রাজনৈতিক দল যেভাবে গর্জে উঠছে তাতে দেশের মানুষ ভয় পাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ভয় পাচ্ছেন বেশি। অর্থনৈতিক সংকটে দেশের মানুষ এমনিতেই চ্যাপ্টা। তার ওপর সহিংসতা শুরু হলে মানুষ যাবে কোথায়?'
মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের একটি স্কুলের শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, দেশের মানুষ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ভয় পায়। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। শান্তির সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হিসাব মিলিয়ে দেখছে কোনটি করলে তাদের লাভ আর কোনটিতেই লোকসান। জনগণের কথা তারা ভাবছে না।
হাজারীবাগের একটি লেদার কোম্পানির মালিক মোস্তফা দীপু বলেন, 'ভোটের মৌসুম শুরু হচ্ছে। ফের রাজনীতির আকাশ ঘোলাটে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ মরবে। রক্তাক্ত হবে জনপথ, জ্বলবে গাড়ি, ব্যাংক, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এতে কেবল সম্পদই নষ্ট হবে না, প্রতিদিনই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃস্ব হবে। হোঁচট খাবে অর্থনীতি। ব্যবসা-বণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দেবে। তাই সব পক্ষের সহনশীল হওয়া উচিত।'
মন্তব্য করুন