
জাতীয় সম্মেলন ঘিরে আওয়ামী লীগে বইছে দুই স্রোত। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বপদে থেকে গেলে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে দলের একাংশ। সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়েই ওই অংশের নেতাদের প্রবল আগ্রহ। বিপরীতে দলের অপর অংশ সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখের সম্ভাবনাকে আস্থায় রেখে এগোচ্ছে। তাঁরা নেতৃত্ব বদলের আশায় বুক বেঁধেছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের আগের কয়েকটি জাতীয় সম্মেলনের মতো এবারও বঙ্গবন্ধু পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ঘিরে নেতাকর্মীর মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা হোসেন পুতুল এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে আসছেন কিনা- তা নিয়ে নেতাকর্মীর মনে ব্যাপক কৌতূহল।
এ পটভূমিতে 'উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছে। আগামী শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় সাড়ে আট হাজার কাউন্সিলর এবং সমসংখ্যক ডেলিগেটরের সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের পর কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে আসার পর আধঘণ্টা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হবে। এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করবেন দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ূয়া। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ওবায়দুল কাদের। স্বাগত বক্তব্য দেবেন অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হবে। পরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুরু হবে কাউন্সিল অধিবেশন। এই অধিবেশনে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে। গঠনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তুতি রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দূতাবাসপ্রধানকে জানানো হবে নিমন্ত্রণ। তবে এবার বিদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সম্মেলনে এবার বড় আয়োজন হচ্ছে না। এক দিনেই শেষ হবে সম্মেলনের কার্যক্রম।
এরই মধ্যে সম্মেলনের পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়কের বক্তব্য ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে গড়া মঞ্চ তৈরির কাজও শেষের দিকে। মঞ্চটি হবে তিন স্তরের। প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসবেন দলের সিনিয়র নেতারা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারিতে বসবেন অন্যরা। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের ১৪০ নেতা মঞ্চে থাকবেন।
এদিকে জাতীয় সম্মেলন ঘিরে আওয়ামী লীগে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সম্মেলনে উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরদের দাবির মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে আবারও দলের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হবে- এটা শতভাগ নিশ্চিত। ফলে কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক, কমিটিতে কারা আসছেন কিংবা বাদ পড়ছেন- এ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে বেশি।
দলের একাংশের নেতাকর্মী মনে করছেন, সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদলের সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। তাঁদের যুক্তি, বেশিরভাগ জেলা সম্মেলনে পুরোনোরাই শীর্ষ নেতৃত্বে রয়ে গেছেন। কেন্দ্রেও এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। সেই ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদেরই সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকছেন। অর্থাৎ এই পদে তিনি হ্যাটট্রিক করতে যাচ্ছেন। আর আগামী বছরের এপ্রিলের দিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ওবায়দুল কাদেরের। ওই সম্ভাবনা তৈরি হলে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ শূন্য হয়ে যাবে। তখন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকই হবেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের কোনো পদ নেই।
তবে চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যাঁর নাম প্রথমে থাকে, তিনিই সিনিয়র হিসেবে পরিচিতি পান। আর তাঁকেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
এ জন্যই সম্মেলন ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আলোচনার পুরোভাগে রয়েছেন চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় রয়েছেন দুই সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ও মির্জা আজম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
এদিকে দলের অপর অংশ সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আসতে পারে বলে মনে করছে। তাদের যুক্তি, জেলা সম্মেলনগুলোতে তৃণমূল পর্যায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতৃত্বের অদলবদল না হলেও কেন্দ্রে সাধারণ সম্পাদক পদে বদলের সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সম্মেলনে তারই আভাস মিলেছে। এই তিন সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এমনকি আলোচনায় আসেননি, এমন নেতৃত্বও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও নতুন মুখ আসতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতাদের কেউই মুখ খুলতে চাননি। তবে দলের নেতাকর্মী তাঁদের কাছে জানতে চাইছেন, সাধারণ সম্পাদক পদে কার সম্ভাবনা বেশি? কে এগিয়ে আছেন? নেতাকর্মীর এসব প্রশ্নের জবাবে নীতিনির্ধারক নেতাদের সবাই প্রায় এক বাক্যে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত পাওয়া নেতাই হবেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক। অবশ্য তিনি (শেখ হাসিনা) জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত জানাবেন।
তবে এখন পর্যন্ত দলের অনেক নেতাকর্মী তাঁদের নিজস্ব বিচার-বিশ্নেষণে সাধারণ সম্পাদকের পদে অনেকের ভিড়ে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেই আলোচনার শীর্ষে রাখছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে, ওবায়দুল কাদেরের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। তাঁকে বেশ নির্ভার মনে হচ্ছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তিনি প্রতিটি জেলা সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলায় রাজনীতির মাঠ চষে বেড়িয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সমকালকে বলেন, 'আমি কখনোই সাধারণ সম্পাদক পদে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করিনি। তবে আবারও আমার ওপর দায়িত্ব এলে আমি সেটাকে আওয়ামী লীগের পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য করে দায়িত্ব পালন করব।' তিনি আরও বলেন, 'সাংগঠনিক তৎপরতার দিক থেকে বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদ বেশ সফল। কেন্দ্রীয় নেতাদের পারফরম্যান্স বেশ ভালো। এই অবস্থায় কাকে রেখে কাকে বাদ দেওয়া হবে, সেটা বাছাই করা বেশ মুশকিল। তবে সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে নতুন মুখ আসবে।'
অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন, দলের জাতীয় সম্মেলনের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ কারণে দলের তৃণমূল পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নেতাদেরই সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে নির্বাচন করা হবে। বিশেষ করে নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের বেলায় অবশ্যই সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার পাশাপাশি সর্বস্তরের নেতাকর্মীর কাছে গ্রহণযোগ্য নেতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের ইতিহাসে কোনো নেতাই দু'বারের বেশি সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার সুযোগ পাননি। সুতরাং এবার এই পদে নতুন মুখ আসবে।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর তিন সদস্য- কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমানের নাম সাধারণ সম্পাদকের আলোচনায় রয়েছে। এই পদে আরও আলোচনায় রয়েছেন চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- মাহবুবউল-আলম হানিফ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। অবশ্য তাঁদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেদের আগ্রহের কথা জানাননি।
বঙ্গবন্ধু পরিবারই আগ্রহের কেন্দ্রে :আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধু পরিবারের চার সদস্য- শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা হোসেন পুতুল ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে আসুক। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁদের কেউই এই মূহূর্তে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে আসতে চাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে সামলিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা। অন্যরা খুব একটা অ্যাকটিভ না হলেও নানাভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরা সাংগঠনিক কাজে আগ্রহ দেখালে অবশ্যই আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে আসবেন। তবে চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর দুই দৌহিত্র সায়মা হোসেন পুতুল ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। বঙ্গবন্ধুর আরেক দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দেশে নেই।
আজ থেকে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড বিতরণ :জাতীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের সব সাংগঠনিক জেলা-মহানগর শাখার কাউন্সিলর বা ডেলিগেট কার্ড আজ বুধবার সকাল ১১টা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বিতরণ করা হবে। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অথবা তাঁদের যৌথ সইয়ের চিঠিসহ মনোনীত প্রতিনিধিরা কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন।
মন্তব্য করুন