- রাজনীতি
- পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আর কতদিন
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আর কতদিন

সভা-সমাবেশের কোনো বক্তব্যই মাটিতে পড়তে দিচ্ছেন না প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা! সমানে চলছে কথাযুদ্ধ। পাশাপাশি রাজপথেও মুখর তারা। সংসদ ভোটের এক বছর আগেই মাঠ দখলের মহড়ায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিএনপি কর্মসূচির ডাক দিলে আওয়ামী লীগও একই দিন পাল্টা হাজির হচ্ছে রাজপথে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে রাজনীতির ময়দান নিজেদের অনুকূলে রাখতে। তবে বিরোধী দলের সাধারণ মিছিল-সমাবেশের মতো অহিংস কর্মসূচির বিপরীতে ক্ষমতাসীন দল 'শান্তি সমাবেশ' ডাকায় ঘন ঘন চড়ছে উত্তেজনার পারদ। বড় দুই দলের রাজপথের মিছিল-সমাবেশ ঘিরে যানজট আর ভোগান্তি মানুষের অসহনীয় ঠেকছে।
আগামীতেও বিএনপির প্রতি কর্মসূচির দিন রাজপথের থাকার ঘোষণা এরই মধ্যে দিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। এ পটভূমিতে সামনে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন- তাহলে কী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এভাবেই একই দিন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলতেই থাকবে? এর কী শেষ নেই?
তাঁরা বলছেন, এটা ঠিক, বিএনপি-আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সহিংসতা হচ্ছে না। তার পরও বিরোধী দলের কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের কর্মসূচিতে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। এটা জনমনে যেমন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তেমনি বিরোধী দলও তাদের কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনার সুযোগ পাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্যও সুখকর না।
সবশেষ আজ বুধবারও দেশজুড়ে যুগপৎ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে আজ দুপুর ২টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে এবং ১০ দফা দাবি আদায়ে তাদের এই কর্মসূচি। বিএনপির মিত্র দলগুলোও আলাদাভাবে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
আজকের সমাবেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। সূত্র জানায়, যুগপৎ কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতিতে বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রতিবাদ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিসহ ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে। এদিকে একই দিন পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সমাবেশের ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আজ সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সমাবেশ হবে।
এ ছাড়া বিকেল ৩টায় রাজধানীর বনানীতে শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগও শোডাউন করবে। দুই কর্মসূচিতেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা যোগ দেবেন। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীকে আগের মতোই রাজধানীতে সতর্ক অবস্থানে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, বিরোধী দল যেখানে পুলিশকে 'শান্তিপূর্ণ সমাবেশ' করার আশ্বাস দিয়ে কর্মসূচি পালন করছে; সেখানে ক্ষমতাসীন দলকে কেন একই দিন পাল্টা 'শান্তিপূর্ণ সমাবেশ' বা রাজপথ পাহারা দিতে হবে? অতীতের মতো বিরোধী দল 'ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড' চালালে না হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলও রাস্তায় নামতে পারে। তবে অহিংস আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর আগে একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিএনপি কর্মসূচি পালনের নামে আগুনসন্ত্রাস, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতা করে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে জনগণের জানমাল রক্ষা করা আওয়ামী লীগের ওয়াদা, দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ কারণেই অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ ও গণসংযোগ চলবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংঘাতে গেছে- এমন একটা ঘটনা কেউ দেখাতে পারবে না। বিএনপির সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাও আওয়ামী লীগের নেই।
অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দাবিতে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করছি আমরা। এতেই জনবিচ্ছিন্ন ও বিনা ভোটের আওয়ামী লীগ সরকার ভয় পেয়ে গেছে। তাই জনরোষের ভয়ে আমাদের কর্মসূচির দিন তারা পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। তবে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীরা কোনো উস্কানিতে পা দেবে না। জনগণ জেগে উঠেছে। তারাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই স্বৈরশাসককে বিদায় করবে।
ভোলায় গত ১ আগস্ট পুলিশের গুলিতে বিএনপির দুই নেতা নিহত হওয়ার পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির প্রতিবাদ কর্মসূচির দিন কিছু জায়গায় পাল্টা কর্মসূচি দিতে থাকে আওয়ামী লীগও। পরে বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশসহ আর কোনো কর্মসূচিতেই এককভাবে রাজপথে থাকতে পারেনি। বিএনপির নেতৃত্বে ৫৪ দল ও সংগঠনের যুগপৎ তিনটি বড় গণমিছিল, গণঅবস্থান এবং সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচির প্রতিদিনই পাল্টা শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
অবশ্য ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে বিএনপির যুগপৎ গণমিছিল কর্মসূচির তারিখ বদলের আহ্বান জানালে সাড়া দেয় দলটি। ওই দিন সারাদেশে কর্মসূচি পালন করলেও ঢাকার কর্মসূচি ৩০ ডিসেম্বর স্থানান্তর করে বিএনপি। অবশ্য আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিলেও বিএনপির পরিবর্তিত কর্মসূচির দিনেও রাজপথে ছিল ক্ষমতাসীন দল।
এ পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা থেকে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলের কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় উদ্ভূত পরিস্থিতির সব দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও সরকারকেই নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে দলটি। তবে বিএনপির এই আহ্বানে এখনও ইতিবাচক সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ।
শুভবুদ্ধির উদয়ের আশা :সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া। এ ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ আছে বলে তো দেখছি না। তিনি বলেন, এখনকার রাজনীতি আর মানুষের কল্যাণের জন্য হয় না। বরং এটা ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার মতো বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একে অপরের মুখোমুখি হওয়া কিংবা চরম সহিংসতা ও ডরভর দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা- এগুলোই এখন রাজনীতির প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সরকার ও বিরোধী দলকে পরস্পরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ এবং পরমতসহিষুষ্ণতা দেখাতে হবে।
হুঁশিয়ারি বিএনপির :বিরোধী দলের সূত্রের দাবি, সংঘাতের রাজনীতির পক্ষে সরকারের আগ্রহ বেশি। কেননা, সব বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সরকারের। তাদের মাধ্যমে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি দুদকও সমান্তরাল ভূমিকা রাখছে। সর্বশেষ দুদকের কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা কমিশনের বদলে সচিবের হাতে নেওয়ার মাধ্যমে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। সরকারের বাহিনী ব্যবহারের পাশাপাশি নিজস্ব সুবিধাভোগী নেতাকর্মীকে এ লড়াইয়ে যুক্ত করতে চাচ্ছে। যদি কখনও কোনো কারণে প্রশাসন নিরপেক্ষ হয়ে যায়, তখন গণরোষের মুখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য দলীয় বাহিনীই হবে শেষ ভরসা। এ কারণে বিরোধী দলের প্রতিটি কর্মসূচির মুখোমুখি দাঁড় করাতে হচ্ছে দলীয় বাহিনীকে।
বিএনপি নেতারা জানান, শান্তিপূর্ণ অহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত গড়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে চায় বিএনপি। সেই কৌশলেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি। বিরোধী দলের প্রধান শক্তি জনসম্পৃক্ততা। এই জনসম্পৃক্তাকে লাগাতার ধরে রেখে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে থাকতে হচ্ছে বিরোধী দলকে। রাষ্ট্রীয় শক্তির মুখোমুখি তখনই বিরোধী দল দাঁড়াতে পারবে, যখন সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিপরীতে নিরস্ত্র শান্তিকামী জনতার শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ক্ষমতা হবে শক্তিশালী।
সম্ভাব্য নৈরাজ্য মোকাবিলার দাবি আওয়ামী লীগের :আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন, আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। বরং বিএনপি ও তার মিত্রদের সহিংস কর্মসূচি ঘিরে সম্ভাব্য নৈরাজ্যকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার প্রচেষ্টা নিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারবিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিকে ঘিরে কোনো ধরনের সহিংসতা হলে এর তাৎক্ষণিক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বলেন, বিএনপি রাজপথে নির্বিঘ্নেই কর্মসূচি পালন করছে। আওয়ামী লীগ তো কোথাও হামলা করছে না। বরং বিএনপিই ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন বিরোধী দলের বেশিরভাগ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে।
তিনি বলেন, এখনও আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছে বিএনপি। তারা এমনকি পুলিশের ওপরও হামলা চালিয়ে উস্কানিমূলক অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছে মাত্র।
মন্তব্য করুন