আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোন পথে হাঁটছে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ইসলামী দলগুলো। এ কারণে থমকে গেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে কওমি ধারার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোট গড়ার উদ্যোগ। অন্যদিকে বিএনপি কী করে তা দেখার ইচ্ছায় যুগপৎ আন্দোলনে নেমেও পিছুটান দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আর আওয়ামী লীগ সরকারের বশ মেনেছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

গত আগস্ট থেকে দুই খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন, এনডিপিসহ কয়েকটি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে মতবিনিময় করে ইসলামী আন্দোলন। নির্বাচনী জোট গড়াই ছিল উদ্দেশ্য। গত অক্টোবরে বিভাগীয় গণসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি রাজপথের কর্মসূচিতে ফেরায় এই উদ্যোগে এখন ভাটার টান। ধর্মভিত্তিক ও অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) জোট গঠনের উদ্যোগও তালগোল পেকেছে অভ্যন্তরীণ সংকট আর রাজপথে বিএনপির সক্রিয়তায়।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে, বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলে বিকল্প হবে জাপা এবং ইসলামী দলের জোট। তবে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে গতিশীল হওয়ায় এবং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল কথা বলা শুরু করায় পরিস্থিতি বদলে গেছে। ধর্মভিত্তিকসহ অন্য ছোট দলগুলো এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কী করে তা দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। তারা খোলা রাখতে চাইছে সুবিধা নেওয়ার সব দরজা।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে জোট আর নেই। কোনো সুবিধা নিতে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে পিছুটান দেয়নি। নিজের মতো করে যুগপৎ আন্দোলন করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে জামায়াত অনড়। কার সঙ্গে জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করা যায় তা দাবি পূরণের পর দেখা যাবে।

ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদের দাবি, মতবিনিময় গত বছর অনেক গতি পেলেও থমকে আছে দলীয় কর্মসূচির কারণে। তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলনের সম্মেলন ও নতুন কমিটি হয়েছে। জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন চলছে। এ কারণে মতবিনিময়ে ভাটা পড়েছে। তবে তা আবার শুরু হবে।

ভোটের পরিসংখ্যানে জামায়াতের পর বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক দল চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। তবে গত বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রায় ২৪ হাজার এবং রংপুরে প্রায় ৫০ হাজার ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় হয়ে চমক দেখায় হাতপাখা।

গত ১৪ বছরে জামায়াত ও কওমি ধারার ইসলামী দলগুলো বন্ধুর পথ মাড়ালেও ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতি ছিল অনেকটা সাবলীল। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, জামায়াতের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে দলটির উত্থানে সরকারের 'সহযোগিতা' রয়েছে। যদিও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে এবং অন্য ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলনকে সরকারের সমালোচনামুখর থাকতে দেখা যাচ্ছে।

আগামী জানুয়ারিতে যদি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়, তবে নভেম্বরে হতে পারে তপশিল। হাতে সময় মাত্র ৯ মাস। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব বলেন, 'সবার মতামত জানছি। নির্বাচনে অংশ নেব কিনা। নিলে কীভাবে নেব, আন্দোলন কীভাবে হবে- এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় আছে। এরপর আগে বাড়ব।' তিনি জানান, জোট গড়তে হলে শুধু ইসলামিক নয়, দেশপ্রেমিক দলগুলোকেও ডাকা হবে। বিএনপি দেশপ্রেমিক দলের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব বিতর্ক ছিল, সেগুলো এখনও আছে। বিএনপির সঙ্গে বসা হবে কিনা- এ সিদ্ধান্ত হয়নি।

দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলোর চার ধারা। প্রথম ধারা মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর অনুসারী জামায়াত। ধর্মভিত্তিক দলের দ্বিতীয় ধারা দেওবন্দের উসূলের অনুসারী। নিবন্ধিত ১০ ধর্মভিত্তিক দলের ছয়টি- ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং খেলাফত মজলিস এ ধারার অনুসারী। এ ছাড়া আরও বহু অনিবন্ধিত দল রয়েছে, যারা দেওবন্দের অনুসারী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক।

শেষ দুটি ধারা হলো সুফিবাদী এবং দরবারভিত্তিক। দরবারভিত্তিক দুই নিবন্ধিত দল তরীকত ফেডারেশন এবং জাকের পার্টি। একমাত্র তরীকতেরই সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। দলটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। ফরিদপুরের বিশ্ব জাকের মঞ্জিলভিত্তিক জাকের পার্টি জোটে না থাকলেও সরকারের সমর্থক। সুফিধারার দুই নিবন্ধিত দল ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও সরকার সমর্থক।

ইসলামী আন্দোলন বাদে বাকি নিবন্ধিত পাঁচ দলের নেতারা ছিলেন হেফাজতের নেতৃত্বে। ভাস্কর্য এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অতিথি করার বিরোধিতা করে ২০২১ সালের মার্চে রাস্তায় নামে হেফাজত। হরতালে সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়। সহিংসতার মামলায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ ছয় শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। জমিয়ত ও দুই খেলাফতের অন্তত ৫০ নেতা গ্রেপ্তার হন সহিংসতার মামলায়। বাংলাদেশ খেলাফতের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকসহ কয়েকজন এখনও কারাগারে। মামুনুল হক হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।

নেতারা কারাগারে থাকা অবস্থায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি 'চাপে' পড়ে বিলুপ্ত করা হয়। পরের কমিটি থেকে রাজনৈতিক সংশ্নিষ্টদের প্রায় সবাইকে বাদ দেওয়া হয়। পরের ২১ মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকের পর গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নেতাকর্মীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবি জানান হেফাজত নেতারা।

সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতে হেফাজত রাজনীতি থেকে দূরে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনটি সরাসরি নির্বাচন না করলেও, ভোটে প্রভাব রাখার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করা হয়। রাজনৈতিক সূত্র বলছে, মামলায় জেরবার হেফাজত সরকারের বশে এসেছে। আগামী নির্বাচনে সংগঠনটি আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবে না- এমন কথাও চাউর আছে।

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী সমকালকে বলেন, রাজনীতি করা, না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শাহ আহমদ শফী নিজেই তা পরিস্কার করে গেছেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে সংগঠনের বর্তমান আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। হেফাজতের নেতাকর্মী তা মেনে চলছেন। কোনো নির্বাচনেই হেফাজতের ভূমিকা থাকবে না।

হেফাজতের কর্মসূচিতে সহিংসতার মামলায় জমিয়ত এবং খেলাফতের উভয় অংশ চাপে রয়েছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কয়েক ঘণ্টা পর জমিয়ত নেতারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। আড়াই মাস পর জোট ছাড়ে খেলাফত মজলিসও। এর পর দল দুটির নেতারাও একে একে জামিনে মুক্তি পান।

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা এবং আগামী নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দলের জোটের বিষয়ে জমিয়তের সহসভাপতি আব্দুর রব ইউসুফী সমকালকে বলেন, 'নির্বাচনী জোটের সঙ্গে আদর্শের সম্পর্ক নেই। যে কারোর সঙ্গেই হতে পারে। রাজনীতির একটি উদ্দেশ্য সংসদে যাওয়া।' বিএনপি জোটে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়নি মন্তব্য করে আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, 'যার সঙ্গে গেলে জমিয়তের সুবিধা হবে, তার সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে বাধা নেই।'

খেলাফতের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের একাদশ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোটে লড়েন। তিনিও হেফাজতের মামলায় হাজতবাস করেছেন। তিনি বলেন, খেলাফত রাজনৈতিক নয়, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী জোটে আগ্রহী। খেলাফতের প্রস্তাব হচ্ছে, প্রত্যেক আসনেই যেন ইসলামী দলের একক প্রার্থী থাকে। তিনি জানান, নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। অংশ নিলে জোটের বিষয়ে আগামী আগস্টে সিদ্ধান্ত হবে। তবে যে কারোর সঙ্গে নির্বাচনী জোটের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই নেতা।

ইসলামী ঐক্যজোটও এক সময় বিএনপির জোটে ছিল। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের সঙ্গেই ছিল বাংলাদেশ খেলাফত। দলগুলো এখন সরকারের প্রতি নমনীয়। তবে সূত্র বলছে, দাবি আদায় করতে না পারলে তারা বিএনপির দিকে ঝুঁকবে। বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখতে পারলে আওয়ামী লীগ যেভাবেই চাইবে, সেভাবেই ভোটে অংশ নেবে।

যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর মতো পুলিশের অনুমতি পাচ্ছে না জামায়াত। বিনা অনুমতিতে গত ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে একইদিন গণমিছিল করে। এসব কর্মসূচিতে জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। বিএনপির ১০ দফা সমর্থন করার দু'দিন পর গ্রেপ্তার হন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। বিএনপি তাঁর গ্রেপ্তারের নিন্দা করেনি। ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে গ্রেপ্তার জামায়াতের কর্মীদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেয়নি।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এক যুগ ধরে কোণঠাসা জামায়াতের সঙ্গে এলডিপি ছাড়া আর কোনো দল নেই। দুই মাসের মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল মামলা শেষ করতে বলেছেন আপিল বিভাগ। এ পরিস্থিতিতে কে হবে, আগামী নির্বাচনে জামায়াতের বন্ধু? প্রশ্নে দলটির নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, জামায়াত এ নিয়ে চিন্তিত নয়। জামায়াত নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক দল। সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত হলে নির্বাচনী জোটের বিষয়ে ভাবা যাবে। জামায়াতের এককভাবে নির্বাচন করার ইতিহাস রয়েছে।