দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কোনো সংসদ সদস্য নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চাইলে আওয়ামী লীগ তাতে রাজি আছে। তবে চলতি সংসদে বিএনপি না থাকায় তাদের নিয়ে নতুন করে চিন্তার সুযোগ নেই।

দেশে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা আবারও নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আলোচনায় কীসের জন্য ডাকতে যাব? তাদের ডিমান্ডই তো ঠিক নেই। দেশের রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে রিজার্ভের কোনো সংকট নেই। এ নিয়ে দুশ্চিন্তারও কিছু নেই।

গতকাল সোমবার তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাম্প্রতিক জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ওপর যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশের কাছ থেকে কেনাকাটা না করার জন্য সরকারি ক্রয়বিধিতে নতুন ধারা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিষ্কার কথা– যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেসব দেশ থেকে আমরা কিছুই কিনব না। এতে সংকট আর ভয়ের কী আছে? বাংলাদেশ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়।

বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কার পয়সায় আন্দোলন করছে? কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে?

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তাঁর তিন দেশ সফরের অভিজ্ঞতা লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এর পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন তিনি। এই প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচন সামনে রেখে সংলাপের সম্ভাবনা, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর অভিযোগে র‍্যাব এবং সাবেক ও বর্তমান সাত পুলিশ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কখনও হাস্যোজ্জ্বল রসিকতায় মাতেন; কখনও বা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ সময় সরকারপ্রধানকে বেশ প্রাণোচ্ছলও দেখাচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলনটি বিটিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক, কর্মাধ্যক্ষ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

কোনো সংসদ সদস্য নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চাইলে রাজি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো কী হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্রেসি ফলো করি। ব্রিটেনে যেভাবে নির্বাচন হয়, তারা যেভাবে করে, আমরা সেভাবেই করব।
এর মধ্যে একটু দেখতে পারি, সংসদ সদস্য যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন, নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চান, আমরা নিতে রাজি আছি। এর আগে আমরা (নির্বাচনকালীন সরকারে) নিয়েছি।
বিএনপির বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে তো খালেদা জিয়াকেও আমি আহ্বান করেছিলাম। তাঁরা আসেননি। এখন তো তাঁরা সংসদেও নেই। কাজেই তাঁদের নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই।

সংলাপের সম্ভাবনা কার্যত নাকচ করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কাদের আলোচনায় ডাকব? কীসের জন্য ডাকতে যাব? তাদের ডিমান্ডই তো ঠিক নেই।

নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এত দুশ্চিন্তা কীসের? কথা নেই বার্তা নেই, নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখাবে, আর আমরা ভয়ে বসে থাকব কেন? নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।
তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। যারা আমাদের সপ্তম নৌবহরের ভয় দিয়েছিল, আমরা সেটাও পার করে বিজয় অর্জন করেছি– এ কথা ভুললে চলবে না। আত্মবিশ্বাসটা নিয়ে চলতে হবে। আত্মবিশ্বাস থাকলে এক বেলা খেয়ে থাকব, তাতেও অসুবিধা নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, আর আমাদের কী কারণে নিষেধাজ্ঞা দিল? যাদের দিয়ে আমরা সন্ত্রাস দূর করলাম; যাদের দিয়ে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলাম, তাদের ওপরই নিষেধাজ্ঞা কেন? নিষেধাজ্ঞায় আমাদের কী হয়েছে? কিছুই হয়নি।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছি, এখন থেকে আমরা যে বিদেশ থেকে জিনিসপত্র ক্রয় করি, সেখানে আমাদের একটা ক্লজ থাকবে– যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেবে, তাদের থেকে আমরা কোনো কিছু কেনাকাটা করব না। এর মধ্যে দুটি পদক্ষেপ আমি আগেই নিয়েছি।’

আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও হলে ছাড় নেই

বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তারা আন্দোলন করুক, কোনো আপত্তি নেই। কোনো বাধাও দেওয়া হবে না। কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও কিংবা কোনো মানুষকে আবারও পোড়াতে গেলে কাউকে ছাড়ব না। মানুষের ক্ষতি আর করতে দেব না।

এ প্রসঙ্গে ২০১৩-১৪ সালে নির্বাচন বানচাল ও সরকার পতনের আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, সেই পোড়া মানুষগুলোর চেহারা, তাদের কষ্ট দেখলে কষ্ট হয় না? এক-একটা পরিবার কী অবস্থায় আছে, কেউ কি খবর রাখে? কী বীভৎস অবস্থা সৃষ্টি করেছে এই বিএনপি-জামায়াত!
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ২০ দলীয় ঐক্যজোট সিট পেয়েছে মাত্র ২৯টি। এখন তারা আবার বড় বড় কথা বলে! কার পয়সায় এই আন্দোলন করছে? কোত্থেকে টাকা পাচ্ছে? বাংলাদেশের মানুষ এত অন্ধ হয়ে গেছে? চোখে দেখে না? হাজার হাজার কোটি টাকা যে লুট করে নিয়ে গেছে আর কাদের মদদে করছে, সেটি একটু খোঁজখবর নেন না। প্রতিদিন লোক নিয়ে আসে আর প্রতিদিন মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। এমনি এমনি বিনা পয়সায় তো আর হচ্ছে না। কত দিচ্ছে, কত লোক আনবে, মোটরসাইকেলে কতজন আসবে– সেসব হিসাব তো আছে।

শেখ হাসিনা বলেন, সরকার উৎখাত করবে! আমি জানি, এই আন্দোলন করে কোথাও থেকে তারা লাভবান হচ্ছে। তারা যত পারে আন্দোলন করুক। আমি জনগণের সঙ্গে আছি; তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসই আমার একমাত্র শক্তি। বাবা-মা-ভাই সবই হারিয়েছি। আমি এখন দেশের জন্য কাজ করে যাই। আমার হারানোর কিছু নেই।
নির্বাচন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাহলে কি আমরা ভয় পাব? কেন ভয় পাব? জনগণের জন্য কাজ করেছি। জনগণ যদি ভোট দেয়, ক্ষমতায় আছি। না দিলে নাই। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। যেহেতু করোনার কারণে আমরা ২০২৪ সালে করতে পারিনি, ২০২৬ সালে করব। সেটুকু করে দিয়ে যেতে চাই। এ জন্যই নির্বাচনটা করতে চাই।

অন্যান্য প্রসঙ্গ
করোনা সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উন্নত দেশেও মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকট চলার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেদিক থেকে আমরা ভালো আছি। আমাদের মানুষদের প্রণোদনা দিয়েছি। এবার রোজার সময় তো কোনো হাহাকার শোনা যায়নি।

দেশের কিছু নাগরিক দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বিদেশে যায় বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের কিছু মানুষই বাংলাদেশের বদনাম করে। অথচ তারা যে কত রকম দুর্নীতি, অপকর্ম, কত কিছুর সঙ্গে জড়িত, সেগুলো তো সাংবাদিকরা খুঁজে বের করে না। খুঁজলে দেখা যাবে অনেক কিছু পাওয়া যাবে। এরাই বাংলাদেশের বদনাম করে।