রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) সারাবিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব-জনসংখ্যার আনুমানিক ১৮০ কোটি মানুষ রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। হিমোগ্লোবিন লোহিতকণিকার একটি অংশ। এটা অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রক্তে বয়ে দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে। কোষে বিপাকের ফলে যে কার্বনডাই-অক্সাইড তৈরি হয় তা হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে ফুসফুসে নিয়ে যায়। আর সেখান থেকেই দেহ তা বাইরে নির্গত করে। অক্সিজেন দেহের কোষে সরবরাহকৃত পুষ্টি উপাদান (নিউট্রিয়েন্ট) যথা শর্করা উপাদানকে জারিত করে শক্তি উৎপাদন করে, যা দেহের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। দেহের জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ অর্থাৎ মেটাবলিজমসহ বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। রক্তস্বল্পতায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকে, যা দেহের চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না। ফলে দেহের জৈব রাসায়নিক কার্যক্রম (মেটাবলিজম) সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয় না। সংগত কারণে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি সমস্যা হিসেবে রক্তস্বল্পতার গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং তার ব্যাপকতাও গভীর।

সম্প্রতি বাংলাদেশে আমরা (দুই জনস্বাস্থ্য-পুষ্টিবিজ্ঞানী ড. সবুক্তগীন রহমান এবং ড. নাজমা শাহীন) বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া রিপোর্টিংয়ের ওপর একটি নতুন ধারণা প্রস্তাবনা করেছি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটিই প্রথম রক্তস্বল্পতার রিপোর্টিংয়ের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ ও বৈজ্ঞানিক ধারণা। ‘বিহাইন্ড দ্য সিন অব দ্য প্রিভেইলেন্স অব অ্যানিমিয়া: অ্যান এক্সটেন্ডেড ওয়ে অব রিপোর্টিং’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে ধারণাটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ধারণা সংবলিত প্রবন্ধটি সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য-পুষ্টির একটি শীর্ষ জার্নাল পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনে প্রকাশিত হয়েছে।

যে কোনো জনগোষ্ঠীতে রক্তস্বল্পতার কারণ বহুবিধ। কিন্তু দেহে আয়রন বা লৌহের ঘাটতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতাকে লৌহের অভাব মনে করা হয়। তাই কোনো জনগোষ্ঠীতে রক্তস্বল্পতার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট মানের ওপরে থাকলেই প্রতিকার হিসেবে আয়রন সাপ্লিমেন্টেশন প্রোগ্রাম বিবেচনা ও বাস্তবায়ন করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই রক্তস্বল্পতার প্রেক্ষাপট নজরে আনা অত্যাবশ্যক। সুনির্দিষ্ট কারণগুলো বিবেচনায় না নিয়েই আয়রন সাপ্লিমেন্টেশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হলে তা যেমন সমস্যাটি দূর করে না, অন্যদিকে আয়রন ঘাটতি ছাড়া আয়রন সাপ্লিমেন্ট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করলে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি মানবদেহে  বিভিন্ন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

সাধারণত কত শতাংশ মানুষের হিমোগ্লোবিন মাত্রা একটি নির্দিষ্ট মানের নিচে আছে, সেই সংখ্যামান দিয়ে কোনো জনগোষ্ঠীতে রক্তস্বল্পতার প্রাদুর্ভাব পরিমাপ করা হয়। রক্তস্বল্পতার রিপোর্টিংয়ের নতুন ধারণা হলো রক্তস্বল্পতার প্রাদুর্ভাবের বর্ধিত রিপোর্টিং। গবেষণায় প্রদর্শিত পদ্ধতির এই নতুন ধারণা অর্থাৎ বর্ধিত রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে রক্তস্বল্পতার প্রাদুর্ভাবের মানের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট স্থান বা প্রেক্ষাপটে রক্তস্বল্পতার মূল প্রভাবক এবং এগুলোর সংখ্যাসূচক একটি ব্রাকেটের মাধ্যমে রিপোর্ট করা যাবে। অ্যানিমিয়ার প্রভাবক ও এগুলোর সংখ্যাসূচকের মান দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থান কিংবা দেশে  অ্যানিমিয়ার সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত কারণ এবং কারণগুলোর আপেক্ষিক মাত্রা জানা যাবে। ফলে কারণসাপেক্ষে যথাযথ হস্তক্ষেপ নির্ণয় ও পরিকল্পনা করা সহজ  হবে। জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণ, সুপেয় পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ পানির আয়রন এবং থ্যালাসেমিয়া অ্যানিমিয়ার প্রধান এবং কাঠামোগত প্রভাবক। উল্লিখিত প্রবন্ধে এই প্রভাবকগুলোর মানসূচক নির্ণয় এবং তার পদ্ধতি প্রদর্শন করা হয়েছে। মানসূচক অনুসারে বাংলাদেশের মূল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কম এবং প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়িয়ে অ্যানিমিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে। মানসূচক অনুসারে বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানিতে বিদ্যমান আয়রন এবং থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব এই ইঙ্গিতই দেয়– আয়রন সাপ্লিমেন্টেশন প্রোগ্রাম পরিকল্পনায় এ দুটি বিষয়কে আমলে এনে তবেই কার্যক্রম পরিকল্পনা করা উচিত। ভবিষ্যতে কার্যক্রম পরিকল্পনা ও নকশায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে।

গবেষণাতে অন্যান্য দেশ যেমন আফ্রিকার কিছু দেশ  যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানে অ্যানিমিয়ার বর্ধিত রিপোর্টে অন্য প্রভাবকগুলোর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া বিবেচনা ও তার মানসূচক নির্ণয় করে অ্যানিমিয়া প্রোগ্রাম প্রণয়ন ও মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। অ্যানিমিয়ার প্রধান বা কাঠামোগত প্রভাবকগুলোর মানসূচক নির্ণয়ের মাধ্যমে যথাযথ হস্তক্ষেপ প্রণয়ন ও অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ সীমিত করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আয়রনজনিত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রোধ করা সম্ভব হতে পারে।  উপরন্তু রক্তস্বল্পতার হস্তক্ষেপের ব্যাপ্তি ও কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। সেই সঙ্গে প্রোগ্রাম বা কার্যক্রমের কার্যকর মূল্যায়নও করা যেতে পারে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পদের অপচয় যেমন রোধ হবে, তেমনি কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে রক্তস্বল্পতার প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।

এই গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে নির্মিত কার্যক্রমের বাস্তবায়ন বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে  অ্যানিমিয়া নিয়ন্ত্রণের একটি বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর প্রক্রিয়া হতে পারে। এই কার্যক্রম প্রয়োগের মাধ্যমে রক্তস্বল্পতার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে, যা রক্তস্বল্পতা দূরীকরণের একটি বৈজ্ঞানিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং কার্যকর কার্যক্রমের প্রথম ও প্রাথমিক ধাপ।

ড. সবুক্তগীন রহমান: অতিথি অধ্যাপক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ড. নাজমা শাহীন: অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় : রক্তস্বল্পতা নিয়ন্ত্রণে সবুক্তগীন রহমান নাজমা শাহীন

মন্তব্য করুন